দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: করোনার কারনে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য সরকার নতুন টাকা ছাপানোর মাধ্যমে চাহিদা পুরণ করার যে উদ্দ্যোগ গ্রহন করেছে যা অত্যন্ত সময়োপোযোগী।একটা দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন করতে বেশি করে টাকা তৈরি করা কোন সমাধান নয়, সমাধান হলো উৎপাদন বৃদ্ধি করা।তবে সময়ে সময়ে চাহিদা অনুযায়ী টাকার যোগান দেওয়াও উৎপাদন বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে।

নতুন করে অর্থনীতেতে ৬৩ হাজার কোটি টাকা (স্বাভাবিক নিয়মে ২৫ হাজার কোটি টাকা যেটা সাধারণত প্রতি ঈদে ছাপানো হতো আর রিজার্ভ হতে ৩৮ হাজার কোটি টাকা বন্ডের বিপরিতে )আসার ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে তবে তা উৎপাদনের তুলুনায় কেবল বেশি হলেই ।অনেকেই আবার আমার সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করে বলবেন যে,অতিরিক্ত এই টাকার ফলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হবে।

কিন্তু আমি মনে করি এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি বাড়বে না কারন করোনার কারনে অর্থনীতিতে সৃষ্ট গ্যাপের ফলে টাকার যে প্রধান বৈশিষ্ট টাকার হাতবদল তা অনেকটা ব্যাঘাত ঘটেছে এবং করোনার পুর্ববর্তী সময়ে জননৈত্রী শেখ হাসিনার বড়সড় শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার ফলে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বিশাল পরিমাণ কালো টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাহিরে চলে দিয়েছে তার কারনে ব্যাংক ও মানুষের হাতে এই মূহুর্তে পর্যাপ্ত টাকার সরবরাহ নেই।

তাই অতিরিক্ত ৬৩ হাজার কোটি টাকা এলেও বড় ধরনের মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।বরং এ টাকা ছাপানোর ফলে অর্থনীতিতে গতি আসবে ।বরং দেশের এ সংকটকালীন মূহুর্তে মানুষের হাতে টাকা গেলে সে টাকায় কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমুল্য পাবে বলে নতুন উৎপাদন বৃদ্ধিকরতে উৎসাহিত হবে।

এছাড়াও দেশের প্রধান দুই পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত অধিকাংশ শেয়ার ফেজ ভ্যালু/ফেজ ভ্যালুর নিচে থাকায় নতুন করে ছাপানো টাকা হতে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি অংশ ইনভেস্টমেন্ট আকারে পুজিবাজারে বিনিয়োগ হবে।সরকার ধীরগতির পুঁজিবাজার টেনে তোলার জন্য ব্যাংকগুলোকে এক্সপোজার লিমিটের বাহিরে বিশাল বিনিয়োগের যে সুযোগ প্রদান করেছে তাতে করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আর এ সুযোগে আর্থিক খাতের ধুঁকতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভবান হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে।দেশের পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে সঠিক ভ্যালুতে নিয়ে আসার জন্য এখানে অনেক বড় বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। যেখানে বিশ্বের পুঁজিবাজারের স্টান্ডার্ড প্রাইজ আর্নিং রেসিও ২০ এর কাছাকাছি সেখানে আমাদের দেশের পুঁজিবাজারের বর্তমান পিও রেসিও ১২/১৩ তে ঘুরপাক খাচ্ছে।

এছাডাও দেশের পুঁজিবাজারের অন্যতম আর্থিক খাত ইন্সুরেন্স সেক্টরের ব্যাপক সংস্কারের ফলে পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগ ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে। সরকারের নতুন করে বিশাল পরিমাণ নতুন টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্তের ফলে দেশের দুই পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে।

আর এতে করে দেশে নতুন নতুন শিল্প কল-কারখানা সৃষ্টি হওয়ার মাধ্যমে উৎপাদন ও কর্মসংস্হান বাড়বে যা দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।শক্তিশালী পুজিবাজার সৃষ্টির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে মুল্যস্ফীতি নিয়ন্তনে রাখার সরকারের নয়া এ কৌশল অত্যন্ত কার্যকরী বলে প্রতিয়মান হবে বলে আমার বিশ্বাস।

করোনার কারনে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় টাকার চিরাচরিত বৈশিষ্ট হাতবদল হওয়া কমে গেছে যার ফলে টাকা একটি জায়গায় স্থির হয়ে পড়ে আছে যা টাকার উপযোগিতা কমিয়ে দিয়েছে।এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন যে টাকা ছাড়বে তা তো বিভিন্নভাবে বন্ড ও বিল ছেড়ে পর্যায়ক্রমে দুই/তিন বছরের মাথায় সরকার বাজার থেকে তুলে নেওয়ার চেস্টা করবে ফলে মূল্যস্ফীতিতে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না।সরকার কর্তৃক ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যাপ্ত তারল্য সহায়তা দিতে হবে। কেননা বর্তমানে ব্যাংক খাতে ব্যাপক তারল্য সংকট রয়েছে।

আবার কভিড-১৯ মহামারীর কারণে ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ ও ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রয়েছে।এতে করে তাদের নতুন করে বিনিয়োগ সম্ভাবনা কমে গেছে ফলে উৎপাদনে গতি আনতে হলে সরকারের টাকা ছাপানো ছাড়া বিকল্প পথ নেই ।অনেক সময় অধিক পরিমাণে ছাপানো টাকা দেশের অর্থনীতিকে আরো বেশি অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে কিন্তু সেই অবস্থা আর বর্তমান পরিস্থিতি এক নয় ।

টাকা ছাপানোর পরিমাণের সঙ্গে জড়িত মূলত দেশের মানুষের আয়-উপার্জন, অর্থনৈতিক চাহিদা, দেশের সম্পদের উৎপাদনশীলতার।যেকোনো দেশের সরকারের যত ইচ্ছে টাকা প্রিন্ট করার স্বাধীনতা রয়েছে তবে দেশের মোট সম্পদের তুলনায় অতিরিক্ত টাকা উৎপাদন করলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায় টাকার দাম বা ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।সাধারণত একটি দেশের জিডিপির ২/৩ শতাংশ টাকা প্রিন্ট করা হয়, তবে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে এই হার ৪ শতাংশ হলেও সমস্যা হয় না।

ধরুন একটা দেশে সম্পদ রয়েছে ১০০ টি তরমুজ আর সেই দেশ বছরে ২০০ টাকা প্রিন্ট করে । পরিবহন খরচ, খুচরা মূল্য,পাইকারি মূল্য, ইত্যাদি জটিলতা বাদ দিয়ে ধরে নিলাম প্রতিটি তরমুজের মূল্য ২ টাকা তাহলে দেশের মোট সম্পদের মুল্য আর মোট কারেন্সির পরিমান সমান হলো । পরের বছর ওই দেশ সর্বমোট ৪০০ টাকা প্রিন্ট করলো কিন্তু মোট সম্পদ বলতে ১০০ টি তরমুজই রইলো যেহেতু নতুন কোনো সম্পদ সৃষ্টি হয় নাই তাই ওই দেশটির তরমুজ কেনার জন্য বরাদ্দ হলো ৪০০ টাকা অর্থাৎ প্রতিটি তরমুজের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেলো।

এই ভাবেই দেশের মোট সম্পদের তুলনায় অতিরিক্ত টাকা উৎপাদন করলে দ্রব্য মূল্য বেড়ে যায়,টাকার দাম বা ক্রয় ক্ষমতা কমে যায় আর তখনই মুদ্রাস্থীতি হয়। দ্রব্য মূল্য বেড়ে গেলে বেশি করে টাকা ছাপিয়ে আর লাভ কি হলো । তাই একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রীতিমত গবেষণা করে চাহিদা নির্ধারণ করেই সে অনুযায়ী টাকা প্রিন্ট করে ।

করোনার কারনে আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন উৎপাদন সে পরিমান বৃদ্ধি না পেলেও টাকার হাতবদলের পরিমাণ একেবারেই কমে যাওয়ায় যে পরিমান মূল্যস্ফীতি হওয়ার কথা তা এখন হবে না।এছাডাও সরকার বিগত বছরগুলোতে সাধারন ব্যাংক ব্যবস্থা হতে বিভিন্ন মেঘা প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক টাকা ধার করায় আগে থেকেই বাজারে তারল্য সংকট রয়েছে যা এখন নতুন করে ছাপানো টাকার মাধ্যমে দূর হবে বলে আমার বিশ্বাস।

বিভিন্ন মেঘা প্রকল্পের বিনিয়োগ যেহেতু মোট উৎপাদন বাড়ার সাথে সম্পৃক্ত তাই আগামী অর্থবছর যে বৃহৎ বিনিয়োগ প্রকল্প পদ্মা সেতু চালু হবে তাতে করে দক্ষিনবঙ্গের নতুন নতুন শিল্পকলকারখার উৎপাদন জিডিবিতে চলে আসবে ফলে ছাপানো টাকার মাধ্যমে দীর্ঘসময় মূল্যস্ফীতি হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসবে। তবে একেবারেই নতুন টাকা ছাপানোর আগে মনে হয় আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যায়।

যেমন বিল, বন্ড এগুলো সরকার কিনে নিতে পারে। সরকার নতুন করে বন্ড বা বিল ইস্যু করে বাজারে ছাড়তে পারে। আবার ব্যাংকগুলোর ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) এবং স্টেটিউটরি লিকুইডিটি রেশিও (এসএলআর) আরও কমিয়ে দিতে পারে। এতেও খানিকটা সুবিধা পাওয়া যাবে। তবে যদি এসবের কোনোটিতেই পরিস্থিতি সামলানো না যায় তাহলে তো টাকা ছাপাতেই হবে।

সরকার এসএলআর ও সিআরআর রেসিও কিছুদিন পুর্বে কমানোর পরও তারল্য সংকট না কাটায় টাকা ছাপানোর উদ্দ্যোগ গ্রহণ করে ।দেশে এ মুহূর্তে অবশ্য মূল্যস্ফীতির চাপ বেশ সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। নতুন করে টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়া হলে সেই মূল্যস্ফীতির চাপ তো কিছুটা বাড়বেই। তবে সেটাকে সহনীয় পর্যায়ে ধরে রাখতে পারলে জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর এর একটা প্রভাব পড়বে না। এখন তো মানুষের হাতে এমনিতেই টাকার সরবরাহ কম। তাই আগে টাকার সরবরাহ বাড়াতে হবে ।আর এ বাড়ানোর ফলে তেমন মুল্যস্ফীতি হবে না।

শেখ হাসিনা সরকারের বিগত ১১ বছরের বিভিন্ন সফলতা ধরে রাখা নির্ভর করবে করোনা পরবর্তী বিভিন্ন যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের জন্য।তবে আপাতত সরকার যে বিশাল অংকের টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্হান বৃদ্ধি পাবে এবং শক্তিশালী পুজিবাজার সৃষ্টিতে সহায়ক হবে নি:সন্দেহে।আর এটাই হলো জননেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বের বহি:প্রকাশ।

মো:আবুল খায়ের (হিরু), ডেপুটি রেজিস্ট্রার,সমবায় অধিদপ্তর, ঢাকা।