সাইফুল হোসেন: ২০১০ সালের বড় পতনের পর বাংলাদেশের শেয়ারবাজার বিনিয়োগকারীদের জন্য খুব আশার জায়গা হয়ে ওঠেনি আর। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা লাভের প্রত্যাশায় বারবার শুধু লোকসানকেই বরণ করে নিয়েছেন। এমনিতেই শেয়ারবাজার অন্য বাজার থেকে রূপ, বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন, এই বাজারে সবাই সমানভাবে মানিয়ে নিতে পারেন না, যেটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, সারা বিশ্বের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। দেখা যায় প্রায় ৯০ শতাংশ বিনিয়োগকারী এখানে পুঁজি হারান, লোকসান করেন, আর মাত্র প্রায় ১০ ভাগ বিনিয়োগকারী লাভ ঘরে তুলে নিয়ে যান।

সত্যি কথা বলতে কী, এই বাজার সবার জন্য নয়। যাদের বিনিয়োগ করার মতো অর্থ থাকার পাশাপাশি আর্থিক ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত জ্ঞান আছে, ব্যষ্টিক অর্থনীতি বিষয়ক ধারণা আছে, একটি কোম্পানির ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্ট বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আছে, সর্বোপরি ধৈর্য আছে ও লোভ, ভয় ও রাগসহ ঋণাত্মক ও ধনাত্মক আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আছে তাঁদের জন্য এই বাজার ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে। আমরা অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি খুব কম মানুষ এই বাজার থেকে লাভসহ টাকা উঠিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন।

আরও পড়ুন…….

করোনাভাইরাসে রেকর্ড ২৪ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ছাড়াল ৩০ হাজার 

বর্তমান সময়ে মানবজাতি এক ভয়াবহ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। করোনার প্রভাব আমাদের জীবনযাত্রাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে গেছে। চলতি বছর আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়তো ৪ থেকে ৫ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হয়তো শূন্যে গিয়ে পৌঁছাবে এমনটিই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠান। ব্যষ্টিক অর্থনীতির সব নির্দেশক এখন ঋণাত্মক দিকে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তাই শেয়ারবাজার যখন খুলবে তখন কোনোভাবেই আশা করা ঠিক হবে না যে খোলার সঙ্গে সঙ্গে সূচক বাড়তে শুরু করবে।

আমরা জানি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড না থাকলে আয় থাকে না, সঞ্চয় থাকে না, বিনিয়োগযোগ্য টাকা থাকে না মানুষের হাতে, ক্রয় ক্ষমতা থাকে না, ব্যয় করার ক্ষমতা থাকে না। ফলে অর্থনীতিতে স্থবির অবস্থার জন্ম হয়। সুতরাং যারা শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারী তাঁদের কাছে এখন বিনিয়োগ করার মতো টাকা থাকবে না বা খুব কম থাকবে অর্থাৎ নতুন শেয়ার কেনার চাহিদা কমে যাবে এই আশঙ্কা করতেই হয়।

যদি বড় বিদেশি বিনিয়োগ আসে তাহলে কেনার চাপ তৈরি হতে পারে কিন্তু সে আশা করা খুব যৌক্তিক হবে বলে মনে হয় না। কারণ, এই সমস্যা বিশ্বব্যাপী। তবে আমাদের শেয়ারের দাম এত নিচে নেমে গেছে যে এখন কেনার প্রকৃত সময়। সেজন্য যদি কোনও বিদেশি ফান্ড ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি বা কোনও বড় বিনিয়োগকারী এখানে বিনিয়োগ করেন সেটা আমাদের জন্য খুব খুশির খবর হবে, যদিও সেই সম্ভাবনা বেশি নয়।

আরও পড়ুন…….

ঈদে নিজস্ব পরিবহনে বাড়ি ফেরা যাবে 

উল্লেখ্য, আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট চলছিল কয়েক বছর ধরে। তাছাড়া গত বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ঋণের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। এবং করনা সংকটকে কেন্দ্র করে সরকারি প্রণোদনা ঘোষণা করার পরবর্তী সময়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপের কারণে এখন বাজারে তারল্য বেড়েছে। তবে সেই তারল্য শেয়ার মার্কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।

তাছাড়া ব্যাংকগুলোর যে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার কথা, করোনা পূর্ববর্তী সময়ে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে সেটাও কতটা বাস্তবায়ন হবে এই এখনকার অর্থনৈতিক স্থবিরতার সময়ে সেটা পরিষ্কার করে কিছু বলা মুশকিল। করোনার সংকট কতদিন দীর্ঘস্থায়ী হবে সেটাও আমরা জানি না। সার্বিক বিচারে বাজারে নতুন চাহিদা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম বলেই মনে হচ্ছে।

আমরা আমাদের শেয়ারবাজারকে ব্যবসায়ীদের পুঁজি সংগ্রহের বড় কোনও জায়গা হিসেবে তৈরি করতে পারিনি, পারিনি এটাকে বিনিয়োগকারীদের কাছে একটা আস্থার জায়গা হিসেবে দাঁড় করাতে। গেলো প্রায় অর্ধযুগ ধরে যেসব নতুন কোম্পানি নিবন্ধিত হয়েছে তার অধিকাংশই দুর্বল ভিত্তিসম্পন্ন, যেগুলো নিবন্ধিত হওয়ার কিছুকাল পর থেকেই মূল দাম হারাতে শুরু করেছে।

এক্ষেত্রে বলতেই হয় যে নতুন কোম্পানিগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় দক্ষতা, পেশাদারিত্ব, সততা ও জবাবদিহি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে নতুন ভালো দেশি-সরকারি ও বেসরকারি এবং বিদেশি কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনা সম্ভব হয়নি। ফলে একটা টেকসই বাজার আমরা পাইনি। বিএসইসির প্রাক্তন চেয়ারম্যানের সততা ও দক্ষতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল, তাঁর ওপর অনাস্থা ছিল অধিকাংশের, এটাও বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার কারণ হিসেবে দেখা যায়।

বর্তমানে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যার সুনাম আছে শিক্ষক হিসেবে। আবার ভোরের কাগজের একটা রিপোর্ট দেখলাম যে তিনি ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণখেলাপি এবং তাঁর নামে মামলাও আছে। এটা সত্যি হলে বিনিয়োগকারীদের মনে আবার সংশয় তৈরি হবে যে তিনি কীভাবে সততা ও দক্ষতার সঙ্গে সব সামলাবেন, যেখানে এই বাজার অনেকদিন ধরে ধুঁকে ধুঁকে চলছে।

যাহোক, সার্বিক বিচারে ঈদের পর যদি শেয়ারবাজার খোলে আর করোনার সংক্রমণ বেড়েই চলে, তাহলে বিনিয়োগকারীদের জন্য  এবং এই বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য সেটা খুব ভালো কোনও খবর হবে না। কারণ, শেয়ারবাজার পতনের ধারায় থাকার সম্ভাবনা বেশি। সবার যেহেতু এখন শুধু খেয়ে পরে টিকে থাকাটাই মুখ্য বিষয় এবং অধিকাংশের হাতেই টাকা নেই, তাই অনেকেই শেয়ার বিক্রি করে টাকা বের করতে চাইবেন, তা লাভ লস যাই হোক না কেন। আর বিপদটা সেখানেই। কারণ, আমরা জানি যখন জোগান বেড়ে যাবে তখন দাম কমবে যদি সমান বা বেশি চাহিদা না থাকে। চাহিদা কম থাকার সম্ভাবনা যেহেতু বেশি তাই দাম কমার সম্ভাবনাও খুব বেশি।

তথ্যমতে, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধস নামছে বৈশ্বিক শেয়ারবাজারেও। ২০০৮ সালের মন্দার পর এই প্রথম এত মারাত্মক দরপতন দেখলো বৈশ্বিক শেয়ার বাজার। গত ৯ই মার্চ ২০২০ যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান অর্থনৈতিক সূচকে ৭ শতাংশের বেশি দরপতন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জে ওইদিন স্থানীয় সময় সকাল থেকেই শেয়ারের দরপতন শুরু হয়। একপর্যায়ে পরিস্থিতি এমন হয় যে, ১৫ মিনিটের জন্য শেয়ার কেনাবেচা বন্ধ রাখা হয়। অন্যদিকে লন্ডনের শেয়ারবাজারে প্রায় ৮ শতাংশ দরপতন হয়েছে। ইউরোপেও প্রধান প্রধান শেয়ারবাজারে দরপতন হয়েছে। ফ্রান্স, জার্মানি ও স্পেনে ৭ শতাংশের বেশি দরপতন দেখা গেছে।

এর আগে এশিয়ার শেয়ার বাজারগুলোতেও দরপতন দেখা যায়। জাপানের নিক্কেই ২২৫ সূচকে ৫ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ার এএসএক্স ২০০-এ ৭ দশমিক ৩ শতাংশ দরপতন দেখা গেছে। চীন ও হংকংয়েও একই অবস্থা দেখা গেছে। এমআইটির ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু লো বলেছেন, ‘বিশ্ববাজারে বর্তমানে যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, তাতে পরিস্থিতি ভালোর দিকে না গিয়ে আরও খারাপ হচ্ছে।’ শেয়ারবাজার খুললে দেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিক্রয় বাড়াতে পারেন। সব মিলিয়ে বিক্রয়ের চাপ থাকবে বলেই মনে হয়।

এই অবস্থায় আমাদের কী করা উচিত সেটা মূলত সবাই জানেন। শেয়ার বিক্রি না করে চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকা উচিত। সবচেয়ে বেশি যেটা করা দরকার সেটা হচ্ছে ভালো ভালো মৌল ভিত্তির শেয়ার, যাদের দাম সর্বকালের সর্বনিম্ন, সেসব শেয়ার ক্রয় করা। যারা বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারী তাঁরা এরকম বাজে সময়ের জন্য অপেক্ষা করেন। সময়টা এখন তাঁদের, যাদের হাতে নগদ টাকা আছে।

এখন আপনি মানসিকভাবে তৈরি হন যে যত বিপদ আসুক আপনি শেয়ার বিক্রি করবেন না। জানি অনেকেই পারবেন না। এখন আসলেই বিক্রির সময় নয়। যতদূর পারেন শেয়ার ধরে রাখুন। ডিভিডেন্ড নিন। পারলে শেয়ার কিনে রাখুন। শেয়ারবাজার একটা চলন্ত চাকার মতো। অনেক দিন ধরেই নিচে অবস্থান করছে কিন্তু একটা সময় এটা উপরে যাবেই।

যদিও সেই পর্যন্ত অসীম ধৈর্য ধরে নির্ভয়ে নির্ভার হয়ে বসে থাকা সহজ কথা নয়। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, আপনি তো বিনিয়োগকারী, জুয়াড়ি নন, আপনাকে সতর্ক হতে হবে, শক্তিশালী মনের অধিকারী হতে হবে। আপনাকে যে ১০ শতাংশ বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার থেকে লাভ করে বেরিয়ে যায় তাঁদের একজন হতে হবে।

আমাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে সরকার অন্যান্য খাতকে যেভাবে প্রণোদনা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন, শেয়ারবাজারে যারা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী আছেন তাঁদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথাসময়ে যথাযথ উদ্যোগ নেবেন। পরিশেষে দুরন্ত আশাবাদী হতে ইচ্ছে করে যে একদিন আমাদের শেয়ারবাজার অনেক শক্তিশালী বাজারে পরিণত হবে, ব্যবসায়ীরা পুঁজি সংগ্রহের হাতিয়ার হিসেবে এই বাজারকে ব্যবহার করবেন এবং এই বাজার সব ধরনের অসৎ নেতৃত্ব ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত হবে।  লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক। ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল। Email: hossain.shaiful@gmail.com