দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: মুক্তি পাওয়ার পর প্রায় দুই মাস গুলশানের বাসা ফিরোজা’য় অবস্থানকালে মাত্র ক’জন নিকটাত্মীয় ও দুজন দলীয় নেতা ছাড়া আর কারও সঙ্গে দেখা করেননি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাসহ অনেকেই তার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করলেও তিনি তাদের সে সুযোগ দেননি। তবে ঈদের পর তিনি সবার সঙ্গেই দেখা করবেন।

টানা সোয়া দুই বছর কারাবন্দী জীবন কাটানোর পর একান্তে গুলশানের বাসায় ৫৮ দিন সময় পার করলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ৭৫ বছর বয়সে এভাবে নিরিবিলি পরিবেশে একান্তে প্রায় ২ মাস সময় কাটানো তার জীবনের একটি বিরল ঘটনা। এ সময় অসুস্থ খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার তেমন উন্নতি না হলেও নিয়মিত প্রিয় স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে পেরে তিনি এখন স্বস্তিতে আছেন।

সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হলেও মানসিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে।

মুক্তি পাওয়ার পর দেড় মাস পুরোপুরি হোম কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন। তখন দু’একজন স্বজন ছাড়া বাইরের কারও সঙ্গে দেখা না করলেও পরে তিনি দুজন বিএনপি নেতার সঙ্গে দেখা করছেন এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতির খোঁজখবর নিয়েছেন। তবে ঈদের পর থেকে তিনি দলীয় নেতাসহ আগ্রহী সবার সঙ্গে দেখা করতে চান। আর আপাতত বাসায় বসেই চিকিৎসা নিলেও ঈদের পর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য তার বাইরে যেতে হতে। সরকারের অনুমতি পেলে লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকা খালেদা জিয়া তার জন্য গঠিত চিকিৎসা বোর্ডের পরামর্শে বাসায় তার সঙ্গে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা নার্সের মাধ্যমে নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন। এ ছাড়া আপাতত প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাসায়ই করা হয়। তার ডায়াবেটিস এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আছে। শারীরিক অন্য সমস্যাগুলোও স্থিতিশীল রয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে রিউমেটিক আর্থ্রারাইটিস ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছেন তিনি। তবে এসব রোগে ভুগলেও মানসিকভাবে স্বস্তিতে থাকায় তিনি আগের চেয়ে ভাল আছেন। তাই রমজান মাসে নিয়মিত রোজা রাখছেন। এ ছাড়া তিনি অন্যান্য ইবাদতও করছেন। ছোট বোন সেলিমা ইসলাম মাঝে মধ্যে খালেদা জিয়ার জন্য বাসায় তৈরি করা খাবার ও ফলমূল নিয়ে দেখা করতে যান। কোন কোন দিন দুই বোন একসঙ্গে বসে ইফতার করেন।

সূত্র জানায়, কারাগার থেকে বাসায় ফেরার পর থেকে প্রতিদিনই লন্ডনপ্রবাসী ছেলে তারেক রহমান, ছেলের বউ ডাঃ জোবায়দা রহমান, তারেক রহমানের মেয়ে জায়মা রহমান, প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান, তার দুই মেয়ে জাসিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমানের সঙ্গে ফোনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলছেন। এ সময় পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিচ্ছেন।

জানা যায়, তারেক রহমানের স্ত্রী ডাঃ জোবায়দা রহমান খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে লন্ডনের চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতির পর সরকারের অনুমতি পেলে লন্ডনে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়েও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হচ্ছে। তবে তার আগে বিমান চলাচল শুরু হলে লন্ডন থেকে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান খালেদা জিয়াকে দেখতে দেশে আসবেন।

বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ২৫ মার্চ ৬ মাসের জন্য মুক্তি পান। স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে করোনা পরিস্থিতিতে বয়স ও মানবিক বিবেচনায় সরকারের নির্বাহী আদেশে তিনি মুক্তি পান। মুক্তির শর্ত হচ্ছে- তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না এবং বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি সরাসরি গুলশানের বাড়ি ফিরোজা’য় ওঠেন।

মুক্তি পাওয়ার দিন স্বজনদের পাশাপাশি বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা খালেদা জিয়ার বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। পরে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরাও সেখানে গিয়ে তার চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। চিকিৎসকদের পরামর্শে মুক্তি পাওয়ার পরদিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ থেকে গুলশানের বাসার দ্বিতীয় তলার শয়নকক্ষে তিনি হোম কোয়ারেন্টাইন শুরু করেন।

প্রথম দেড় মাস বাসার বাইরে থেকে দুজন ডাক্তার এক দিনের জন্য এবং ছোট বোন সেলিমা ইসলাম ও ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার মাঝে মধ্যে গিয়ে দেখা করেন। এর বাইরে কাউকে তার গুলশানের বাসায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। তবে ১১ মে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ১২ মে বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমূল বিশ্বাস বাসায় গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন।

মুক্তি পাওয়ার একদিন পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ থেকে গুলশানের বাসার দ্বিতীয় তলায় হোম কোয়ারেন্টাইন শুরু করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শে বাসায়ই অসুস্থ খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলে। লন্ডন থেকে তারেক রহমানের স্ত্রী ডাঃ জোবায়দা রহমান তার চিকিৎসার সার্বিক বিষয়টি তত্ত্বাবধায়ন করেন। এ জন্য প্রতিদিনই তিনি শাশুড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

খালেদা জিয়া হোম কোয়ারেন্টাইন শুরুর পর বোন সেলিমা ইসলাম, ভাই শামীম ইস্কান্দার ও তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা মাঝে মধ্যে গুলশানের বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। চিকিৎসার প্রয়োজনে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডাঃ এজেডএম জাহিদ হোসেন ও ডাঃ মামুন কখনও কখনও গিয়েছেন।

জানা যায়, বাসায় তৈরি করা নিজের পছন্দের খাবার গ্রহণ, ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের পরামর্শে ওষুধ সেবন ও প্রিয় স্বজনদের সঙ্গে নিয়মিত কুশলবিনিময় করতে পেরে খালেদা জিয়া আগের চেয়ে ভাল আছেন। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে তার বাইরে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। নিজের এবং অন্যদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তিনি আসন্ন ঈদ পর্যন্ত গুলশানের বাসায় অবস্থান করেই প্রয়াজনীয় চিকিৎসাসেবা নেবেন। তার বাসায় অবস্থান করছেন দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত কাজের মেয়ে ফাতেমা ও একজন পাচক।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা নিয়ে কারাগারে যান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই অসুস্থ খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা ও মুক্তির দাবি জানাতে থাকে বিএনপি। এক পর্যায়ে বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যও দাবি করে দলটি। গত বছর ১ এপ্রিল পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগার থেকে খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলের কেবিনে নেয়া হয়।

সেখানে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে চিকিৎসা দেয়া হয়। কিন্তু তারপরও খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে তাকে মুক্তির দাবি জানানো হয়। ৮ মার্চ দেশে হানা দেয় করোনাভাইরাস। পরে তা ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে বয়স ও মানবিক বিবেচনায় মুক্তি দিতে সরকারের কাছে আবেদন করে খালেদা জিয়ার স্বজনরা।

এর পর খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার, বোন সেলিমা ইসলাম ও তার স্বামী রফিকুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। এর পর ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে মুক্তি দেয়া হয় খালেদা জিয়াকে।