দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়কালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিপুল পরিমাণে ঋণ নিচ্ছে। গত পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে) রেপোর (পুনঃক্রয় চুক্তি) মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর নেওয়া ধারের পরিমাণ চারগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে রেপোর মাধ্যমে ২ লাখ ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। এ হিসাবে পাঁচ মাসের ব্যবধানে রেপো ব্যবহার করে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ বেড়েছে চারগুণের বেশি।

আরও পড়ুন…….  

পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের শর্ত তুলে নেওয়ার আহ্বান রকিবুর 

চলতি বছর ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি ধার নিয়েছে মার্চ মাসে। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো রেপোর মাধ্যমে ৮২ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা ধার করে। আর গত বছরের সর্বশেষ পাঁচ মাসে ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি ধার নিয়েছিল সেপ্টেম্বরে, যার পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সৃষ্ট ক্ষতি মেটাতে শিল্প, কারখানা, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে সরকার ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি প্রণোদনা স্কিম গঠন করে। এ প্রণোদনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে ব্যাংকগুলোর ওপর। প্রণোদনা স্কিমে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশিরভাগ তহবিলের জোগান দিলেও ব্যাংকগুলোর ওপরও ঋণ দেওয়ার চাপ তৈরি হয়। একই সময়ে ঋণের কিস্তি স্থগিতসহ সুদ আদায় বন্ধ রাখা হয়েছে।

এতে ব্যাংকগুলোর বড় ধরনের তারল্য সংকটের মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সুবিধার মাধ্যমে তারল্য জোগান দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত এপ্রিলে রেপো সুদহার কমানোর পাশাপাশি মেয়াদও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ সময় রেপোর সুদহার ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, রাজস্ব আয় কমে যাওয়ায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণেই মূলত ব্যাংকের ধারের পরিমাণ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যংকের কাছ থেকে রেপোর মাধ্যমে ঋণ নিয়ে ব্যাংকগুলো তা সরকারকে দিচ্ছে। আর সরকার ওই ঋণে করোনাকালীন সময়ে ব্যয় নির্বাহ করছে।

করোনাকালীন সময়ে চলতি বছরের মার্চে সরকারের অনুন্নয়ন ব্যয়ও বেড়ে গেছে। করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয় প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া ছাড়া সরকারের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। ফলস্বরূপ ব্যাংক থেকে সরকারকে বেশি ধার করতে হচ্ছে। আর অনেক ব্যাংক করোনা পরিস্থিতিতে ঋণ আদায় বন্ধ থাকা ও আমানত কমে যাওয়ার কারণে তারল্য সংকটে পড়ে রেপো ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করছে।

চলতি অর্থবছরের বজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ধার নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। তবে করোনাসহ বিভিন্ন কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এনবিআরের আয় কমে যাওয়ায় সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৮২ হাজার ৪২১ কোটি টাকা নির্ধারণ করে। আর ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করেছে।

যদিও করোনাকালীন সময়ে প্রস্তাবিত বাজেটে এনবিআরের আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, বিশেষজ্ঞরা তা অবাস্তব বলে মনে করছেন। ফলে আগামী অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এনবিআর আয় করতে না পারলে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে।

গত ৯ এপ্রিল ব্যাংক ব্যবস্থায় তারল্য বাড়াতে সব ব্যাংকের নগদ জমা সংরক্ষণের (সিআরআর) হার ১ শতাংশ কমায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে এখন থেকে ব্যাংকগুলোকে ৪ শতাংশ হারে সিআরআর রাখতে হবে। এর ফলে ব্যাংক ব্যবস্থায় তারল্য ফিরে আসে ১২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর আগে গত ২৩ মার্চ সিআরআর সাড়ে ৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ নামিয়ে আনায় ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যাংক ব্যবস্থায় যোগ হয়েছিল। এর ফলে গত ২৩ মার্চ থেকে দুই দফায় সিআরআর কমায় ব্যাংকগুলোতে মোট ১৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা তারল্য বাড়ে। আর করোনার কারণে আয় কমে যাওয়ায় অনেক ব্যাংক সিআরআর সংরক্ষণের জন্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন।