দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী ভর্তি রোগী ছাড়া অন্য কারও করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা যায় না। কিন্তু হাসপাতালটির ভাইরোলজি বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে নিয়ম ভেঙে বাইরের লোকজনের করোনা পরীক্ষার অভিযোগ উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে ঢামেকে ভর্তি হওয়া রোগীদের করোনা পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহে বিলম্ব হচ্ছে। হাসপাতালের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত।

তারা টাকার বিনিময়ে বাইরে থেকে লোক এনে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনার নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করাচ্ছেন বলে দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে। ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসিরউদ্দিন বলছেন, এ ধরনের অনিয়মের বিষয়টি তিনিও জানতে পেরেছেন। দ্রুতই জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ার বাসিন্দা নোমান আহমেদ সম্প্রতি করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে ঢামেকে এসে ডাক্তারের পরামর্শ নেন। ডাক্তার তাকে বলেন, এখানে ভর্তি ছাড়া করোনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না। নোমান আহমেদ অভিযোগ করেন, এমন সময় হাসপাতালের একজন কর্মচারী তাকে বলেন, ‘আমি আপনার করোনা পরীক্ষা করে দেব। কিন্তু আপনাকে ৭ হাজার টাকা দিতে হবে।’ নোমান বলেন, ‘আমি ওই কর্মচারীকে অনুরোধ করে ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে করোনা পরীক্ষাটি করি। পরে ওই কর্মচারীর কাছে জানতে পারি টাকা দিলে হাসপাতালে ভর্তি লাগে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘টাকা হলে করোনার রিপোর্টও পরিবর্তন করা যায়।’

রও পড়ুন…

অভিযোগ উঠেছে, হাসপাতালেরই কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। তারা টাকার বিনিময়ে বাইরে থেকে করোনা রোগী এনে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনার স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা করাচ্ছেন। ঢামেকের ভাইরোলজি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীর পাশাপাশি হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষের নির্দেশনায় সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে ভর্তিকৃত করোনা রোগীদের স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়। প্রতিদিনই ২৫০-৩০০ রিপোর্ট ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া নিয়মের বাইরে কিছু কিছু কর্মকর্তার অনুরোধ ভাইরোলজি বিভাগের রাখতে হয়। সেই অনুরোধেই বাইরের কিছু লোকের স্যাম্পল সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী ভর্তি ছাড়া অন্য কোনো রোগীর করোনা পরীক্ষা জন্য নমুনা সংগ্রহ করা যায় না। হাসপাতালের ওয়ার্ডে গিয়ে শুধু ভর্তি হওয়া রোগীদের স্যাম্পল সংগ্রহ করার নিয়ম রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী রিপোর্ট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে হয়। এছাড়া হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে সরকারি কর্মচারী ও হাসপাতালের ভর্তিকৃত রোগীদের স্যাম্পলও পরীক্ষা করা হয়।

ভাইরোলজি বিভাগের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমাদের ভাইরোলজি বিভাগে নিজস্ব টেকনোলজিস্ট মাত্র কয়েকজন। বাইরে থেকে টেকনোলজিস্ট এনে কাজ করাচ্ছি। আমাদের বিভাগে ডাক্তার, টেকনোলজিস্ট ও ক্লিনারসহ বেশ কয়েকজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। লোকবল সংকট থাকলেও নিয়ম ভেঙে হাসপাতালের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের অনুরোধ রাখতে হয়। ঢামেকের ভাইরোলজি বিভাগে একটি মেশিনে দিনে তিনবার পরীক্ষা করা হয়। অনেক লোডের কারণে মেশিনকে বিশ্রাম দিতে হয়। তাই অনেক সময় স্যাম্পলগুলো জমে থাকে। হাসপাতালে করোনা ইউনিটে শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১১ হাজারের বেশি করোনা রোগীর স্যাম্পল সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসিরউদ্দিন অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করে  বলেন, ‘মনে হয় হাসপাতালের কিছু অসাধু ব্যক্তি অর্থের বিনিময়ে বাইরে থেকে লোক এনে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে অনিয়ম করেছে। বিষয়টি জানার পর আমি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। এখন প্রতিদিন আমি নিজেই রিপোর্ট পর্যালোচনা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনা পরীক্ষায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এরপর সুযোগ পাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।’

ঢামেকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ঢামেক হাসপাতালের মূল ভবন বাদে নতুন ভবন ও পুরাতন বার্ন ইউনিটে চলছে করোনা রোগীদের চিকিৎসা। চলতি বছর ২ মে থেকে বার্ন ইউনিটে শুরু হয় করোনা রোগী ভর্তি কার্যক্রম। এরপর অতিরিক্ত রোগী হওয়ায় হাসপাতালের নতুন ভবনেও চালু করা হয় করোনা ইউনিট। গত ২ মে হাসপাতালটিতে করোনা ইউনিট চালু করার পর গতকাল ১৮ জুন পর্যন্ত এ দেড় মাসে করোনা ইউনিটে ৬৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

হাসপাতালটির বর্তমান শয্যাসংখ্যা পুরাতন বার্ন ইউনিট মিলিয়ে ২ হাজার ৯০০। তবে নতুন ভবনের করোনা ইউনিটে ভর্তি রয়েছে ৫০৬ এবং পুরাতন বার্ন ইউনিটে ভর্তি রয়েছে ৮০ জন করোনা পজিটিভ ও সাসপেক্টেড রোগী। আর হাসপাতালটির মূল ভবনে ভর্তি রয়েছে অন্যান্য সব বিভাগ মিলিয়ে ৬৯৬ জন (নন পজিটিভ)।

প্রতিদিন এত বেশি সংখ্যায় করোনা সন্দেহভাজন রোগীর মৃত্যু হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. মজিবুর রহমান বলেন, ‘যারা মারা যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই করোনাভাইরাসসহ নানা জটিলতা নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। এদের করোনা পজিটিভের পাশাপাশি হার্টের সমস্যা, কারও কিডনি সমস্যা, কারও আবার নানাবিধ শারীরিক জটিলতা রয়েছে। এছাড়া দেশের সব অঞ্চল থেকে প্রায় মুমূর্ষু রোগীগুলোই এ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় বা স্বজনরাই নিয়ে আসেন। যাদের আগে থেকেই খারাপ অবস্থা। এদের চার-পাঁচজন হাসপাতালে আনার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত ঘোষিত হয়। আবার কিছুসংখ্যক ভর্তির কয়েক ঘণ্টা পরই মারা যায়। যাদের চিকিৎসা শুরু হলেও মেডিসিন শরীরে কাজ করার আগেই মৃত্যু হয়ে যায়। আর কিছুসংখ্যক রোগী শারীরিক বিভিন্ন জটিলতার কারণে চিকিৎসাধীন মারা যায়।’ সুত্র: দেশ রুপান্তর