দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরে লোকসানের পর এবার অবশিষ্ট পুঁজি নিয়ে নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। যেসব ব্রোকারেজ হাউজের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা লেনদেন করে থাকেন, সেই সব প্রতিষ্ঠানই গ্রাহকদের অর্থ ও শেয়ার আত্মসাৎ করছে। সম্প্রতি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থ আত্মসাৎ করে ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মালিকের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার পর আরও কিছু ব্রোকারেজ হাউজে সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ঘাটতি পেয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ। আইন ভেঙে বেশ কিছু ব্রোকারেজ হাউজ গ্রাহকদের জমা রাখা অর্থ নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে।

রও পড়ুন…

 বিএসইসি নগদ লভ্যাংশ প্রদানে বিইএফটিএন বাধ্যতামূলক করে দিচ্ছে 

সম্প্রতি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকার দেনা নিয়ে পালিয়ে যান ডিএসইর সদস্য প্রতিষ্ঠান ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মালিক মো. শহিদ উল্লাহ। এ ঘটনার পর অন্যান্য ব্রোকারেজ হাউজে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থ জমা নিরাপদে রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট হাউজগুলোর কাছে তথ্য চেয়ে পাঠায় ডিএসই। একই সঙ্গে ডিএসইর রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স ডিভিশন (আরএডি) বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজে তাৎক্ষণিক পরিদর্শন চালায়।

রও পড়ুন…

এমন পরিদর্শনে ডিএসই সদস্য সিনহা সিকিউরিটিজসহ মোট তিনটি ব্রোকারেজ হাউজের সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে (কাস্টমার কনসলিডেট অ্যাকাউন্ট) ঘাটতি দেখতে পেয়েছে। ডিএসইর কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, সবগুলো হাউজ পরিদর্শন করা হলে এমন ঘটনা আরও পাওয়া যাবে। তবে ব্রোকারেজ হাউজ পরিদর্শনে গিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ধরনের চাপের মুখে রয়েছেন ডিএসইর কর্মকর্তারা।

এসব পরিদর্শনের রিপোর্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (এসইসি) পাঠানোর পাশাপাশি ডিএসইর পর্ষদ সভায়ও উত্থাপন করা হয়েছে। ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মালিকের পালানোর পর ডিএসই গত কয়েক দিনে অন্তত ৯টি ব্রোকারেজ হাউজে পরিদর্শন চালিয়েছে। এর মধ্যে সিনহা সিকিউরিটিজের সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ৮ কোটি টাকার ঘাটতি পাওয়া গেছে। এর বাইরে আরও দুটি সিকিউরিটিজ হাউজে কোটি টাকার ঘাটতি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এসব ব্রোকারেজ হাউজ গ্রাহকদের জমা রাখা অর্থ নিজেদের প্রয়োজনে সরিয়ে নিয়েছে, যা সিকিউরিটিজ আইনের লঙ্ঘন। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের পুঁজির নিরাপত্তা নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ ছাড়াও এর আগে শাহ মোহাম্মদ সগির, ডন সিকিউরিটিজ, সিলেট মেট্রো সিটি, ট্রেনসেট সিকিউরিটিজ, মহররম সিকিউরিটিজসহ ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের অন্তত ১০টি ব্রোকারেজ হাউজ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটিয়েছে। চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি বিনিয়াগকারীদের শেয়ার ও অর্থ আত্মসাতের কারণে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সদস্য প্রতিষ্ঠান মহররম সিকিউরিটিজের লেনদেন স্থগিত রেখেছে।

যেসব ব্রোকারেজ হাউজ আত্মসাৎকৃত শেয়ার ও অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছে, স্টক এক্সচেঞ্জ সেসব ব্রোকারেজ হাউজ বিক্রি করে বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত দিয়েছে। কিন্তু এটি অনেক সময় সাপেক্ষ। আইনি জটিলতাও রয়েছে। যেমন সিলেট মেট্রো সিটি ২০১৬ সালে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থ আত্মসাৎ করলেও এখনো অধিকাংশ বিনিয়োগকারী তাদের পাওনা ফিরে পাননি। সিএসইর পক্ষ থেকে ব্রোকারেজ হাউজটি বিক্রি করে পাওনা পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হলেও মামলার কারণে তা আটকে আছে।

শেয়ার আত্মসাতের ঘটনা রোধে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) একটি সফটওয়্যার সংযোজন করেছে। এর মাধ্যমে সিডিবিএলের সঙ্গে স্টক এক্সচেঞ্জের ট্রেড ফাইলের একটি লিংক অ্যানালাইসিস করে সিএসই। এর মাধ্যমে সিডিবিএলের ডিপি থেকে যে শেয়ার ট্রান্সফার হবে, সেটার সঙ্গে সিএসইর ট্রেড ফাইলের একটি সম্পর্ক নির্ণয় করা হয়। এর মাধ্যমে ট্রেডের বাইরে কোনো শেয়ার গেলে তা ধরতে পারে সিএসই।

শেয়ারের দায়িত্বে থাকে ডিপি (ডিপজিটরি পার্টিসিপেন্ট), যেটা কেন্দ্রীয়ভাবে সিডিবিএলের মেইনটেন করার কথা। কিন্তু সিডিবিএল তা সঠিকভাবে পালন করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এর আগে শেয়ার আত্মসাতের ঘটনায় ব্রোকারেজ হাউজের সঙ্গে সিডিবিএল কর্মকর্তাদেরও সংযোগ পাওয়া গেছে। এমন ঘটনায় এর আগে সিডিবিএল তার একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছে।

তবে এরপরও শেয়ার আত্মসাতের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে শেয়ার রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানটি। তবে এ জন্য বিনিয়োগকারীদেরও কিছু দায় রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে বিও হিসাবে শেয়ার লেনদেন হলে সিডিবিএল থেকে সংশ্লিষ্ট বিওধারীর মোবাইল নম্বরে মেসেজ পাঠানো হয়। কিন্তু অনেক বিও হিসাবে মোবাইল নম্বর হালনাগাদ না হওয়ায় ব্রোকারেজ হাউস যদি শেয়ার বিক্রি করে দেয় সে ক্ষেত্রে সিডিবিএলের মেসেজ পাওয়া যায় না।

এদিকে ডিএসইর কর্মকর্তারা বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ পরিদর্শনে গিয়ে নানা রকমের চাপের মুখে পড়েছেন। স্টক এক্সচেঞ্জটির প্রভাবশালী সদস্যরা বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিচ্ছেন, পরিদর্শনে বাধা তৈরি করছেন। আবার ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের ঘটনার পর বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ পরিদর্শন করে সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ঘাটতির বিষয়টি ডিএসইর পর্ষদ সভায় প্রেরণ করা হলেও তা আমলে নিচ্ছে না পর্ষদ। যদিও এসইসির চেয়ারম্যান রুবাইয়াত-উল-ইসলাম দেশ প্রতিক্ষণকে জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব ডিএসইর।

গত ২৩ জুন বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থ নিয়ে ডিএসই সদস্য ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মালিক পালিয়ে যান। তবে ঠিক কী পরিমাণ শেয়ার ও অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে তা এখনো জানাতে পারেনি ডিএসই। যদিও পরবর্তী সময়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ক্রেস্ট সিকিউরিটিজে এখনো ৮২ কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে বলে জানায় ডিএসই। এ ঘটনায় ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মালিক যাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারেন, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছে ডিএসই। একই সঙ্গে ওই ব্রোকারেজ হাউজের পরিচালকদের ব্যাংক হিসাব জব্দে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠায় ডিএসই।

ক্রেস্টের ঘটনার পর সংবাদ সম্মেলনে ডিএসইর এমডি ছানাউল হক বলেন, মাসিক ভিত্তিতে সব ব্রোকারেজ হাউজের কাছ থেকে বিনিয়োগকারীদের কনস্যুলেটেড শেয়ার ও অর্থের হিসাব নেয়। ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ সর্বশেষ যে তথ্য দিয়েছিল, তাতে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বা অর্থের কোনো ঘাটতি দেখা যায়নি। ফলে ব্রোকারেজ হাউজটির মালিকরা এমন একটি কান্ড ঘটাতে পারেন তা বোঝা সম্ভব ছিল না। তবে ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মতো আর কোনো ঘটনা দেশের পুঁজিবাজারে যাতে না ঘটে, তার জন্য এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে সমন্বিত সফটওয়্যারের মাধ্যমে গ্রাহকদের শেয়ার ও অর্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নজরদারি বাড়ানো হবে। এ ছাড়া এখন থেকে স্টক এক্সচেঞ্জকে সঙ্গে নিয়ে সব ব্রোকারেজ হাউজে বিশেষ নিরীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এসইসি।