জামান সাহেল: ভাগ্য বদলের আশায় দোকান, জমি বিক্রি করে যোগাড় করা অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন লিয়াকত আলী যুবরাজ(৪০)। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে শেয়ারবাজার কারসাজি ও ধ্বসের পর আর ঘুরে দাঁড়ায়নি দেশের পুঁজিবাজার; বিনিয়োগ করা কোটি টাকা হারান তিনি। অবশেষে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন লিয়াকত ।  ২০১২ সালের ৩০ জানুয়ারি রাজধানীর গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাসা থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ (সুত্র: দৈনিক প্রথম আলো ৩০-০১-২০১২)।

রও পড়ুন…

তার আত্মহননে পিতৃহারা হয় ৫ বছরের কন্যা মনীষা; বিধবা হন ২৫ বছরের স্ত্রী জাহানারা। জীবনভর যন্ত্রনা সইতে হবে মনীষা আর জাহানারাকে। একইভাবে শেয়ারবাজারে প্রায় কোটি টাকা খুইয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন চট্টগ্রামের দিলদার, রাজধানীর সবুজবাগের মহিউদ্দিন শাহরিয়ার, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।

রও পড়ুন…

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা প্রতিষ্ঠা জরুরি

চট্টগ্রামের দিলদারের লাশ উদ্ধার করা হয় ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। পুজিবাজারে সব পুঁজি হারিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ বহনের ক্ষমতা হারিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি (সুত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ০২-০২-২০১২)। দিলদারের পরিবার এখন অসহায়, নিঃস্ব। শেয়ারবাজারে সব হারানো মহিউদ্দিন শাহরিয়ারের(৩৫) ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত লাশ রাজধানীর সবুজবাগের মাদারটেকের বাসা থেকে পুলিশ উদ্ধার করে ২০১৬ সালের ২৫ মে। বাবার জমি বিক্রি করে শেয়ারবাজারে ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে তিনি এ পথ বেছে নেন সুত্র: দৈনিক সমকাল, ২৬-০৫-২০১৬)। একইভাবে শেয়ারবাজারে দরপতনের খবরে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির(৫২) বনানীর বিটিআই টাওয়ারের ১১তলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।(সুত্র:দৈনিক দেশ রুপান্তর)

লিয়াকত, দিলদার, মহিউদ্দিন, হুমায়ুনের মতো লাখ লাখ বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হয়েছেন। সর্বস্ব হারিয়ে কেউ আত্মহত্যা করেছেন, অনেকেই হৃদ রোগ, মস্তিস্কে রক্তক্ষরণে এখন জীবন্মৃত অবস্থায় আছেন। তাদের পরিবার-পরিজন এখন অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। হয়তো বন্ধ হয়েছে অনেকেরই সন্তানের লেখাপড়া।

আর শেয়ারবাজার লুটেরারা এসব সাধারণ বিনিয়োগকারীর সর্বস্ব লুটে নিয়ে বিলাশী জীবনযাপন করছেন। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মহা আনন্দে। তাদের থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সুবিধা গ্রহণকারীরাও ভাল আছেন। ভাল আছেন তাদের চামচা-চেলা-চামুণ্ডারাও। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রকরা শত চেষ্টা করেও কোনভাবেই এসব লুটেরা ও চামচাদের দমন করতে পারেনি। মহা পরাক্রমশালী এ লুটেরাদের কব্জা থেকে উদ্ধার করতে পারেননি দেশের পুঁজিবাজারকে। বাঁচাতে পারেননি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। পুঁজিবাজার যাতে স্বাভাবিকভাবে নিজস্ব পথে চলতে পারে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সে চেষ্টা কোনভাবেই সফল হতে পারেনি।

রও পড়ুন…

টিকটক লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারীর তথ্য চুরি করেছে ! 

চলতি বছরের শুরু থেকেই কখনও ডিএসইতে সূচক ১০০ পয়েন্ট বাড়লেও পরের কয়েকদিনে পড়েছে ১০০০ পয়েন্টের বেশি। ১৮ মার্চ বাজারে সূচক হারায় ২৮৯ পয়েন্ট। এর আগে ১৬ মার্চও সূচক হারায় ১৮৯ পয়েন্ট। দেখা যায় ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ মার্চ এক মাসে ডিএসইতে সূচক হারায় ১১৭১ পয়েন্ট। ঐ দিন ডিএসইতে ১২৭টি শেয়ার সার্কিট ব্রেকার নির্ধারিত সর্বনিম্ম দরে কেনাবেচা হয়। এই দরপতনে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তারা আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করতে থাকেন। আর শেয়ার সর্বনিম্ন দরে কিনতে শেয়ারবাজারে লুটেরা, কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী।

ডিএসই সূচক পতন সম্পর্কে অনেকটা পরিষ্কারভাবে ধারণা পাওয়া যায় চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত সূচকের দিকে তাকালে। সূচক পতন হতে হতে ১৮ মার্চ এসে দাঁড়ায় ৩৬০৪ পয়েন্টে।

সেই ১৯৯৬ থেকে শুরু। তারপর ২০১০ সালের ধ্বস। বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ২০২০ সালে এসেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি শেয়ারবাজার। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রকদের সব চেষ্টাই যখন ব্যর্থ হয়েছে। তখন ত্রাতা হিসেবে আবির্ভুত হতে হয়েছে ক্ষোদ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রকদের সঙ্গে বসেছেন, পুজিবাজার বাজারে পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এতে একটু আশার আলোর রেখা কখনও দূরে দেখা গেলেও আবার মিলিয়ে গেছে। লুটেরাদের কার্যক্রমে মনে হয়েছে তাদের ক্ষমতা হয়ত সরকারের চেয়েও বেশি।

বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শেয়ারবাজার ভয়াবহ পতন ঠেকাতে আরও পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পথে বসা রোধে ও শেয়ারজারের ভয়াবহ দরপতন ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক ইচ্ছা ও নির্দেশে তখনকার বিএসইসি চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন চলতি বছরের ১৯ মার্চ ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করেন। আর এতে অন্তত আত্মহত্যার পথে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়া থেকে রক্ষা পান সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। তবে এতে মনোক্ষুন্ন হন লুটেরা শ্রেণি। তারা এর বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগে যান। তারা শুধু নিজেরা এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করেন। লেলিয়ে দেন চেলা-চামুন্ডাদের।

শেয়ারবাজার নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনায় মনে হয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করে শুধু লুটেরা শ্রেণিই লাভবান হয়নি। কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও স্টেকহোলডারও সুবিধা নিয়েছেন। এ কারণে তারা ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়ার জন্য বিএসইসির ওপর নানাভাবে, নানা কৌশলে চাপ সৃষ্টি করছেন। তাদের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে, এই মূহূর্তে শেয়ারবাজারে লুটপাটের একমাত্র বাধা ফ্লোর প্রাইস। তারা বারবার এর বিরুদ্ধে সভা-সেমিনার আয়োজন করছেন। বক্তব্য রাখছেন। পত্র-পত্রিকা, অনল্ইান গণমাধ্যম, টেলিভিশনে এর বিরুদ্ধে নানাভাবে অপপ্রচার করছেন।

এর বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টিতে বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে অপৎপরতা চালাচ্ছেন। তারা আর কত সাধারণ বিনিয়োগকারীর লাশ দেখে খুশি হবেন, সেটা তারাই জানেন। আর কত সাধারণ বিনিয়োগকারীকে সর্বোস্ব হারিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় দেখতে চান তারা। তবে মনে হচ্ছে রক্ত পিপাসু হায়েনা যেমন রক্ত দেখে উল্লাসে মেতে উঠে; তারাও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করে, তাদের আত্মহননের পথে ঠেলে দিয়ে সেভাবেই খুশিতে মেতে উঠেন।

এই শ্রেণির অনেকের বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালের শেযারবাজার কারসাজিতে যোগসাজসের অভিযোগ রয়েছে। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথাও শোনা যায়। যেহেতু তাদের কোন শাস্তি হয়নি, সবাই বহাল তবিয়তে আছেন। তাই তারা ফ্লোর প্রাইসের বাতিলের চেষ্টা করতেই থাকবেন। এখন বিএসইসি ও এর চেয়ারম্যানকে ভাবতে হবে তিনি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষে থাকবেন, নাকি লুটেরা শ্রেনির পক্ষে থাকবেন। তিনি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের রক্ষার চেষ্টা করবেন, নাকি লুটেরাদের লুটপাটের সুযোগ দেয়ার চেষ্টা করবেন।

সিদ্ধান্ত নিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে; পুঁজিবাজারে ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, অসহায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের রক্ষায় তিনি যে মায়ের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তা অক্ষুণ্ন রাখবেন, নাকি তাদের বিপদে ঠেলে দেবেন। ফ্লোর প্রাইস বাতিল করা অর্থই লুটেরাদের মনোবাঞ্জনা পূর্ণ করা। তিনি কি সেটাই করবেন? আমরা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি তিনি সেটা কখনই হতে দেবেন না। সুত্র: অর্থসংবাদ

জামান সাহেল, সংবাদ কর্মী ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী