দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: যে যতোই শক্তিশালী হোক, পুঁজিবাজারে কারসাজি করে আর পার পাওয়া যাবে না হুঁশিয়ার করেছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তিনি বলেছেন, পুঁজিবাজার থেকে টাকা নিয়ে পালানোর দিন শেষ। এখানে যারা আগে, বিভিন্নভাবে অনিয়ম যুক্ত ছিলেন, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুঁজিবাজারের ব্যবসা সহজ করার জন্য যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার বিএসইসির পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে, সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে।

তেমনি ২০০৯ সালের পর গ্রামীণফোন ছাড়া ভালো ও বড় কোনো কোম্পানি বাজারে আসেনি। তবে এখন থেকে পুঁজিবাজারে কোনো দুর্বল কোম্পানির ঠাঁই হবে না। একইসঙ্গে ভালো ভালো কোম্পানি বাজারে আনতে প্রয়োজনে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে বিএসইসি সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুঁজিবাজারে গত ১০ বছরে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হয়েছে প্রায় ৮০ থেকে ৯০টি কোম্পানি। এর মধ্যে ছয় থেকে সাতটি ছাড়া বাকি সব কোম্পানি ভালো মানের নয়। এ কারণে ১০ বছর ধরে মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারেনি পুঁজিবাজার। এমনকি চলতি বছরের ১৮ মার্চ ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ৩৬০৩ পয়েন্টে নেমে আসে। পরিস্থিতি সামাল দিতে টানা ৬৬ দিন শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ রাখা হয়।

এর মধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয় সরকার। সেই সঙ্গে পুরনোদের বাদ দিয়ে নতুন তিন কমিশনারও নিয়োগ দেওয়া হয়। নতুন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নিয়ে শেয়ারবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন।

এর মধ্যে আইন লঙ্ঘন করায় কিছু ব্যক্তি ও কোম্পানিকে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়। গত তিন মাসে ১৩টি কোম্পানির আইপিও বাতিল ও ছয়টি কোম্পানিকে অনুমোদন দিয়েছে বিএসইসি। এর মধ্যে এসোসিয়েটেড অক্সিজেনের আইপিওতে গত বৃহস্পতিবার থেকে আবেদন গ্রহণ শুরু হয়েছে। চলবে আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আরো ১২টি কোম্পানির আইপিও অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিগুলো হলো: ওয়ালটন হাইটেক, মীর আখতার হোসেইন, অ্যাসোসিয়েট অক্সিজেন, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন, ডোমিনোজ স্টিল। বিএসইসি সূত্রে এ তথ্য জানা যায়। বিএসইসির চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে আরো ১২টি কোম্পানির আইপিও। যেসব কোম্পানি কমিশনের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে সেসব কোম্পানির মধ্যে ব্যবসায়িক সুনাম রয়েছে, দীর্ঘদিন ব্যবসার অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং ভালো ব্যবসা করছে এমন কোম্পানিই রয়েছে।

তবে এই ১২টি কোম্পানির মধ্যেও তথ্য-উপাত্ত সঠিক না থাকলে কয়েকটির আবেদন বাতিল হতেও পারে। এসব খবরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিএসইসির একের পর এক পদক্ষেপের কারণে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ছে। মুখ ফিরিয়ে নেওয়া অনেক বিনিয়োগকারী আবার সক্রিয় হয়েছেন। ফলে আগস্টে বিশ্বের মধ্যে পারফম্যান্সের দিক থেকে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার শীর্ষ স্থান দখল করে।

এ প্রসঙ্গে বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, আগে কী হয়েছে, সেটা দেখতে চাই না। বর্তমান নিয়ে ভাবতে চাই। যারা নিয়ম মানবে না, তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। এখন থেকে বাজারে কোনো দুর্বল কোম্পানির ঠাঁই হবে না। একইসঙ্গে ভালো ভালো কোম্পানিকে কিছুটা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে হলেও তালিকাভুক্ত করার চেষ্টা করা হবে।

বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠায় কোম্পানির তথ্য ভালোভাবে যাচাই করে আইপিও দেওয়া হচ্ছে ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, সুশাসন যদি শতভাগ নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে একজন মানুষ কেন তার ঘাম ঝরানো অর্থ বিনিয়োগ করবেন। আমরা যদি টাকা-পয়সা বা বিনিয়োগকে নিরাপত্তা দিতে না পারি, ভালো রিটার্ন দিতে না পারি তাহলে কেন তারা আসবেন?

তিনি আরো বলেন, এখন থেকে কেউ যাতে কাউকে ঠকিয়ে, লুট করে, জালিয়াতি করে অর্থ নিয়ে যেতে না পারে সে কাজ সবাই মিলে করতে হবে। আমরা প্রত্যেক কমিশন মিটিংয়ে এ ধরনের কিছু সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। তিনি বলেন, কাউকে জরিমানা করতে আমাদের ভালো লাগে না। তারপরও করতে হয়। এর মাধ্যমে আমরা বাজারে একটা ম্যাসেজ দিতে চাই যে, ভবিষ্যতে অন্যায় করে কেউ ছাড় পাবে না।

জনগণের বিনিয়োগ নেওয়ার পরে যেসব কোম্পানিতে ঠিকভাবে কাজ হচ্ছে না, যারা হঠাৎ করে বন্ধ করে চলে গেছেন, যাদের তালা মারা অফিস ঢাকায় এবং ফ্যাক্টরি গাজীপুরে, যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মানুষকে ঠকানোর চেষ্টা করেছেন, সেসব কোম্পানির বোর্ডও ভেঙে দিয়ে স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা বাড়ানো হবে। সবকিছু আইনের মধ্যে থেকেই করা হবে। দরকার হলে সেই কোম্পানি থেকে জনগণের টাকা ফেরত দিয়ে আমরা তাদের তালিকাচ্যুত করবো।

ইতোমধ্যে ১৩টি কোম্পানি আইপিও বাতিল করেছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। কোম্পানিগুলোর আইপিও আবেদন বাতিল করার মূল কারণ হলো আর্থিক হিসাবে গরমিল এবং স্থায়ী সম্পদের মিথ্যা বা সন্দেহজনক তথ্য প্রদান। কোম্পানির আয়ের সঙ্গে ভ্যাট-ট্যাক্সের এবং ব্যাংক হিসাবের মিল নেই। আবার কোনো কোনো কোম্পানির যৌক্তিক কারণ ছাড়াই রাতারাতি আয় বেড়ে গেছে।

আইপিও বাতিল হওয়া ১৩টি কোম্পানি হলো- ইনফিনিটি টেকনোলজি ইন্টারন্যাশনাল, বি ব্রাদার্স গার্মেন্টস, জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং, আল-ফারুক ব্যাগস, ডেল্টা হসপিটাল, গার্ডিয়ানা ওয়্যারস, বিডি পেইন্টস, বোনিতো এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ, বেকা গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল, এসএফ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ, হজ্জ ফাইন্যান্স, থ্রি এঙ্গেল মেরিনার্স এবং নিয়ালকো অ্যালোস।

জানা গেছে, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, কোনো কোম্পানি মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত তথ্যসংবলিত কোনো আইপিও প্রসপেক্টাস অনুমোদনের জন্য কমিশনে জমা দিতে পারে না। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু যেসব কোম্পানির আইপিও বাতিল হয়েছে, সেগুলোর সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে সংশ্নিষ্ট ইস্যু ম্যানেজার প্রতিষ্ঠানগুলো (মার্চেন্ট ব্যাংক) সব তথ্য সঠিক মর্মে সার্টিফিকেট দিয়েছিল।

এমনকি অডিটর প্রতিষ্ঠানগুলোও আর্থিক প্রতিবেদনের অসংগতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়ে করা আইপিও আবেদন বাতিল করা হলেও একটি বাদে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি, ইস্যু ম্যানেজার (মার্চেন্ট ব্যাংক) এবং অডিটর প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা এখনো নেয়নি বিএসইসি। কোম্পানিগুলোর আবেদনে মিথ্যা তথ্য-উপাত্ত সন্নিবেশ করার ক্ষেত্রে যেসব ইস্যু ম্যানেজার ও অডিট ফার্ম জড়িত ছিল, সেগুলোকেও আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানান বাজার সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে গত ১০ বছরে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা বার বার প্রতারিত হয়েছেন। বাজারে টাকার কোনো সমস্যা ছিল না, কিন্তু আস্থার সঙ্কট ছিল।

তিনি বলেন, গত ১০ বছরে যে কোম্পানিগুলোর আইপিও এসেছে সেগুলো অত্যন্ত মানহীন। আমান ফিড বাজারে আসার আগেও ঋণ খেলাপি ছিলো। তার পরেও আমান ফিডকে বাজারে নিয়ে আসা হলো। এর জন্য ইসুয়ার, অডিট কমিটি এবং স্পন্সরদের বাজার থেকে দূরে রাখলে বাজারে আরো স্বচ্ছতা ফিরে আসবে বলে মন্তব্য করেন ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান। রকিবুর রহমান বলেন, গত ১০ বছর ট্রেডকে নিয়ন্ত্রণ করেছে পূর্বের কমিশন।

তাদের কথায় সূচক বাড়তো আবার তাদের কথায় সূচক কমতো। তিনি বলেন, মানহীন আইপিও যেন বাজারে না আসতে পারে সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। একই সঙ্গে এসব আইপিওর ক্ষেত্রে যেসব ইস্যু ম্যানেজার, আন্ডার রাইটার, অডিটর যারা মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন তাদের পুঁজিবাজার থেকে অন্তত তিন বছর দূরে রাখতে হবে। তিনি বলেন, এ ধরনের শাস্তির উদাহারণ প্রতিবেশী দেশ ভারতে অনেক রয়েছে।

বিএসইসির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কমিশনের সম্প্রতি পদক্ষেপের কারণে দীর্ঘদিন পর পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, যে কাজ শুরু করেছেন তার যেন ছন্দপতন না হয়। ছন্দপতন হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা থাকবে না। বারবার আস্থা হারালে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বাংলাদেশ মার্চেন্টস ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ)-এর সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে ভালো স্টকের সাপ্লাই নেই। কেন ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসছেন না এই বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। দরকার হলে কর সুবিধা দিয়ে ভালো ভালো কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনতে হবে। তিনি বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে আমাদের দাবি এনআরবিদের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তার জন্য নিয়ম সহজ করতে হবে।

এদিকে ২০১০-১১ সালে পুঁজিবাজার ধসে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ২০১২ সালের মার্চ থেকে আইপিওগুলোর জন্য ২০ শতাংশ কোটা সুবিধা ভোগ করছে। সেই ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য সরকার আবারও প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) কোটা সুবিধার মেয়াদ এক বছরের জন্য বাড়িয়েছে।

২০১০-১১-এর বাজার দুর্ঘটনার বিষয়ে বিএসইসির প্রতিবেদন অনুযায়ী কমপক্ষে ৯ লাখ ৬০ হাজার বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই সুবিধাটির মেয়াদ এ পর্যন্ত আটবার বাড়ানো হয়েছে এবং সর্বশেষ বারের মেয়াদ ৩০ জুন, ২০২০ এ শেষ হয়েছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার ৭১ দিন পর ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এই কোটা সুবিধা বাড়িয়েছে সরকার।

বাজারে সাধারণত আইপিওর কিছু শেয়ার ইস্যু মূল্যের চেয়ে বেশি দামে লেনদেন হয়। কারণ লেনদেন শুরু হওয়ার প্রথম কয়েকটি কার্যদিবসে বিনিয়োগকারীর একটি অংশকে সেই শেয়ারের প্রতি আকর্ষণ তৈরি করে। সেটা কোটা সুবিধায় ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের তাদের ক্ষতির কিছুটা মেটাতে সহায়তা করে।