তৌফিক ইসলাম ও মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বর্তমান কমিশন পুঁজিবাজার নিয়ে উদ্যোগ নেওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করেন, ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন পুঁজিবাজার ভালো করতে আন্তরিক, সুতারং বাজার উঠানামার মধ্যে একটি স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গড়ে উঠবে। বর্তমান কমিশন পুঁজিবাজার ইস্যুতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাজার ভাল না হয়ে যাবে না।

রও পড়ুন…

৯০ দিনের মধ্যে আইপিও অনুমোদনের পরিকল্পনা বিএসইসি’র

তারই প্রতিফল দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাজারে। তাছাড়া পুঁজিবাজারে স্মরনকালের বড় ধরনের ধসের কারণে অধিকাংশ ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম অনেক কমে গেছে। এখন এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তবে বাজারে মাঝে মধ্যে কিছু কিছু শেয়ার নিয়ে একটি চক্র কারসাজি করছে এসব নিয়ন্ত্রক সংস্থা সজাগ।

এদিকে দীর্ঘমেয়াদী ও স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে পুঁজিবাজার। কিছুদিন যাবৎ পুঁজিবাজার একটু ইতিবাচক দেখা যাচ্ছে। মূলত বড় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহে ক্ষুদ্রদেরও আনাগোনা বাড়ছে বাজারে। এটি বাজারের জন্য ভালো দিক। সামনের দিনগুলো এভাবেই বাজার ইতিবাচক ধারায় এগোলে মুখ ফিরিয়ে নেয়া বিনিয়োগকারীও আসবেন এবং তাদের বিগত দিনের লোকসান ধীরে ধীরে পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

দীর্ঘদিন পতনের মুখে থাকা পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নিরন্তর কাজ করছেন অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন। তারই ধারাবাহিকতায় সিকিউরিটিজ আইন অমান্য করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থানে কমিশন।

বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, পুঁজিবাজার হলো দেশের শিল্পায়নের জন্য। একটি দেশের পুঁজিবাজার শক্তিশালী হলো সে দেশের অর্থনীতির ভিত্তিও মজবুত হয়। পুঁজিবাজার থেকে সহযে টাকা নিয়ে দেশের শিল্পায়ন করা যায়। দেশের শিল্পায়ন বাড়লে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। কর্মসংস্থান বাড়লে কমে বেকারত্ব। এভাবেই এগিয়ে যায় দেশের অর্থনীতি।

বিশ্বের অন্যদেশে পুঁজিবাজার যেভাবে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশে তেমন হয়নি। তাদের মতে, নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। কমিশন কঠোর অবস্থানে আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে। ফলে আস্থা বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের। বাজারে ফিরছে সাইডলাইনে থাকা বিনিয়োগকারীরা। চাঙ্গা হয়ে উঠছে পুঁজিবাজার।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বে বর্তমান কমিশন পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে এসেছে। এরই সুফল পুঁজিবাজারে দেখা যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের এই আস্থা ধরে রাখাই এখন পুঁজিবাজারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

তারা বলছেন, ২০১০ সালের ধসের পর পুঁজিবাজার বেশ কয়েকবার ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল নেতৃত্ব এবং একের পর এক দুর্বল কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) আসায় বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস দিলেও তা স্থায়ী হয়নি। তবে বর্তমান পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভিন্ন। নতুন কমিশন বেশকিছু দুর্বল কোম্পানির আইপিও বাতিল করে দিয়েছে। অনিয়মের কারণে বেশকিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের জরিমানা করেছে। ফলে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরেছে।

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই ভূমিকা ধরে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে দুর্বল কোম্পানি বাদ দিয়ে বাজারে ভালো ভালো কোম্পানি আনতে হবে। তাহলে বাজারের এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা ধরে রাখা যাবে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে ধুঁকতে থাকা পুঁজিবাজারে মহামারি করোনাভাইরাস আতঙ্কে গত মার্চে বড় ধরনের ধস নামে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় টানা ৬৬ দিন বন্ধ রাখা হয় পুঁজিবাজারের লেনদেন। এর মধ্যেই বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে যোগ দেন আরও তিনজন। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর পুঁজিবাজারে লেনদেন চালুর উদ্যোগ নেন। ফলে টানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর ৩১ মে থেকে শেয়ারবাজারে আবার লেনদেন শুরু হয়।

নতুন নেতৃত্বের অধীনে পুঁজিবাজার চালু হলেও অব্যাহত থাকে লেনদেন খরা। তবে জুলাই মাসে এসে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দেয় নতুন কমিশন। অনিয়মে জড়িত থাকায় একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়। সতর্ক করা হয় সরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) কে।

বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজকে জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা হয়। পরবর্তীতে আইসিবিকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বাতিল করা হয় এক ডজন দুর্বল কোম্পানির আইপিও। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরনের একের পর এক পদক্ষেপের ফলে ঘুরে দাঁড়ায় শেয়ারবাজার। ৫০ কোটি টাকার নিচে নেমে যাওয়া লেনদেন এখন হাজার কোটি টাকার ওপরে দাঁড়িয়েছে। অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে এই লেনদেন।

কমিশন সূত্র মতে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে ইতোমধ্যে ৯টি কোম্পানির ১৭ পরিচালকের পদ শূণ্য ঘোষণা করে আদেশ জারি করা হয়েছে। আদেশের কপি ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। চিঠি হাতে পাওয়ার সাথে সাথেই এটি কার্যকর হবে।

বিএসইসি সূত্র জানায়, পরিচালক পদে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এককভাবে কমপক্ষে ২ শতাংশ এবং উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকার যে শর্ত রয়েছে গত আট বছরে অনেক পরিচালক ও কোম্পানিই এ শর্ত মানেনি। কিন্তু এখন কোনো ছাড় দেবে না কমিশন। এর আগে আরও অনেকগুলো কোম্পানি,ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে যে টাকা আয় করেছে তার সম পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি জরিমানা করছে কমিশন। ফলে আগামীতে এই শেয়ার নিয়ে কারসাজি কমবে বলেও মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্ঠরা।

বিএসইসির একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান কমিশন ব্যক্তির স্বার্থ প্রাধান্য না দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বৃহত্তর স্বার্থ চিন্তা করছে। এর জন্য আইন অনুসরণ করে যেসব পদক্ষেপ নেয়া যায় তার সবই করার চেষ্টা করছে।

এ বিষয়ে এএফসি ক্যাপিটালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব এইচ মজুমদার বলেন, একটি স্বচ্ছ জবাবদিহীমুলক পুঁজিবাজার তৈরি করার জন্য কাজ করছে কমিশন। স্বল্প সময়ে কমিশন অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা পুঁজিবাজারের বিকাশে আরও সহজ করবে। তাছাড়া পুঁজিবাজারের উন্নয়নে নতুন কমিশনের যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপে নতুনভাবে প্রাণ ফিরে এসেছে পুঁজিবাজারে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্চের পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিএসইসি স¤প্রতি বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার পাশাপাশি বেশকিছু কোম্পানির আইপিও বাতিল করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন সাহসী ভূমিকা আগে দেখা যায়নি। এ কারণে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে। যার সুফল এখন দেখা যাচ্ছে।

ডিএসই’র পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, বিএসইসির কার্যকর পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে পুঁজিবাজার খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে এরপরও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বিনিয়োগকারীদের শিক্ষিত হতে হবে। কারন বাজার একটু কারেকশন হলেও আতঙ্ক হওয়ার কিছু নেই। পুঁজিবাজারের কাজই উঠানামা করা। বর্তমান পুঁজিবাজার উঠানামার মধ্যে স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে।

বিএসইসি সে লক্ষে কাজ করছে। বিনিয়োগকারীদের অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে এবং অধিকার আদায়ে সচেতন হতে হবে। গুজবের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। বিনিয়োগকারীরা শিক্ষিত হলেই বাজারের ভিত শক্ত হবে।

তিনি আরও বলেন, গত ১০ বছরে পুঁজিবাজারে কোনো সুশাসন ছিল না। একের পর এক বাজে কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নিয়ে পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে। যেসব নিরীক্ষক মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়ে পুঁজিবাজারে বাজে কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত হতে সহায়তা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাদের পুঁজিবাজারে কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে।

বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আমরা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছি। আমরা চাই একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক পুঁজিবাজার। এর জন্য যা করা প্রয়োজন তা করতে আমরা প্রস্তুত। সবার সহযোগিতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি সুন্দর ও স্বচ্ছ বাজার গড়ে উঠবে বলে আমি বিশ্বাস করি।