তোফিক ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দীর্ঘ দুই বছরের মতো সময় ধরে দেশের পুঁজিবাজার যে সংকটকাল অতিক্রম করছিল তা থেকে উত্তরণের আশা জেগেছে সম্প্রতি। এ উত্তরণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য তা আরও স্বস্তিদায়ক সংবাদে পরিণত হয়েছে। ব্লুমবার্গের তথ্যের ভিত্তিতে হংকংভিত্তিক তহবিল ব্যবস্থাপক এশিয়া ফ্রন্টিয়ার কোম্পানির (এএফসি) এশিয়া ফ্রন্টিয়ার ফান্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর আগস্টে বিশ্বের পুঁজিবাজারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সূচক বেড়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে। এ সময় দেশের পুঁজিবাজারে সূচক বেড়েছে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ।

রও পড়ুন…

ডিসিশন মেকার’কে বিলুপ্ত করতে বিটিআরসিকে চিঠি

এতে আগস্টে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বিশ্বের সেরা পারফর্মিং বাজার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। করোনা মহামারীর অভিঘাত সত্ত্বেও পুঁজিবাজারের এ উত্তরণের পেছনে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত কমিশনের নেওয়া নানা পদক্ষেপকেই অনুঘটক হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা। এর মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করলে যেকোনো ক্ষেত্রে সংকট থেকে উত্তরণ কোনো অসম্ভব বিষয় নয়।

বর্তমান কমিশন পুঁজিবাজার নিয়ে উদ্যোগ নেওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করেন, ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন পুঁজিবাজার ভালো করতে আন্তরিক, সুতারং বাজার উঠানামার মধ্যে একটি গতিশীল পুঁজিবাজার গড়ে উঠবে। কারন বর্তমান কমিশন পুঁজিবাজার ইস্যুতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

দেশের পুঁজিবাজারে বড় বড় কোম্পানি আসতে শুরু করেছে। বড় কোম্পানির সঙ্গে আসছেন বড় বড় বিনিয়োগকারীও। শুধু তাই নয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থার একের পর এক ইতিবাচক সিদ্ধান্তে আশার আলোও দেখছেন বিনিয়োগকারীরা। বাজারের চিত্রও বলে দিচ্ছে, আগামী দিনে আরও পরিচ্ছন্ন হয়ে অর্থনীতি চাঙা রাখতে বড় ভূমিকা রাখবে এই পুঁজিবাজার।

পুঁজিবাজারে এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছে দেশীয় ইলেকট্রনিক্স জায়ান্ট ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। কোম্পানিটি শেয়ারের মাত্র দুই দিনের লেনদেনের তথ্যই বলছে, বড় কোম্পানির প্রতি মানুষের আগ্রহ, চাহিদা ও আস্থা বেশি। প্রথম দিনের প্রথম ট্রেডেই শেয়ারের দর বেড়ে সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করে। আইপিও লটারিতে পাওয়া ২৫২ টাকার শেয়ার প্রথম দিনে লেনদেন হয়েছে ৩৭৮ টাকায়। আর দ্বিতীয় দিনে মাত্র ১০ টাকার শেয়ারের দাম ৫৬৭ টাকায় উঠেছে।

তাছাড়া পুঁজিবাজারে স্মরনকালের বড় ধরনের ধসের কারণে অধিকাংশ ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম অনেক কমে গেছে। এখন এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তবে বাজারে মাঝে মধ্যে কিছু কিছু শেয়ার নিয়ে একটি চক্র কারসাজি করছে এসব বিষয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা সজাগ।

এদিকে দীর্ঘমেয়াদী ও স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে পুঁজিবাজার। কিছুদিন যাবৎ পুঁজিবাজার একটু ইতিবাচক দেখা যাচ্ছে। মূলত বড় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহে ক্ষুদ্রদেরও আনাগোনা বাড়ছে বাজারে। এটি বাজারের জন্য ভালো দিক। সামনের দিনগুলো এভাবেই বাজার ইতিবাচক ধারায় এগোলে মুখ ফিরিয়ে নেয়া বিনিয়োগকারীও আসবেন এবং তাদের বিগত দিনের লোকসান ধীরে ধীরে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

দীর্ঘদিন পতনের মুখে থাকা পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নিরন্তর কাজ করছেন অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন। তারই ধারাবাহিকতায় সিকিউরিটিজ আইন অমান্য করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থানে কমিশন।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওয়ালটন আসায় বাজার মূলধনও বেড়ে গেছে। যখন গ্রামীণফোন বাজারে এসেছিল তখনও মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। এদিকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা শেয়ারবাজারে আসার অনুমোদন পেয়েছে। এই খবরে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়ে গেছে বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, মোবাইল ফোন অপারেটর রবির অনুমোদন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বাড়াতে সহায়ক হবে।

এ ধরনের বড় কোম্পানি বাজারে এলে সঙ্গে করে দেশি-বিদেশি নতুন অনেক বিনিয়োগকারী নিয়ে আসে। গ্রামীণফোনের বেলায় আমরা তেমনটি দেখেছি। এছাড়া বড় মূলধনী কোম্পানি হওয়ায় রবি শেয়ারবাজারে আসার পর বাজার মূলধনও অনেক বেড়ে যাবে।’ রবির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও অনুমোদন পুঁজিবাজারের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক বলেও মনে করেন পুঁজিবাজারের এই বিশ্লেষক। তিনি উল্লেখ করেন, গ্রামীণফোন তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকে ভালো কোনও কোম্পানি আর বাজারে আসেনি। তাই রবি পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত হলে বাজার উপকৃত হবে।

বাজারের তথ্য বলছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সপ্তাহ শেষে বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা, যা তার আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত সপ্তাহে ডিএসই’র বাজার মূলধন বেড়েছে ৯ হাজার ১৯ কোটি টাকা। সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে ডিএসইতে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৯১৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয় এক হাজার ১২৭ কোটি ৬ লাখ টাকা।

গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ৪ হাজার ৫৭৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। তার আগের সপ্তাহে লেনদেন হয় ৫ হাজার ৬৩৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। সে হিসাবে মোট লেনদেন কমেছে এক হাজার ৬১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এদিকে বাজারের প্রতি আস্থা বাড়াতে এ পর্যন্ত দুই ডজনের বেশি নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। অনিয়মের অভিযোগে বিভিন্ন কোম্পানিকে জরিমানাও করা হয়েছে। একইসঙ্গে কারসাজি ঠেকাতে এ পর্যন্ত শুনানিতে ডাকা হয়েছে ২২ কোম্পানিকে। জালিয়াতির ঘটনায় বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবও বন্ধ করা হয়েছে।

অন্যদিকে পুঁজিবাজারে তারল্য বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকও বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যার ফলে বাজার গতিশীল হয়েছে। পুঁজিবাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেড় মাস ধরে বাজার কিছুটা গতিশীল। বাজারের সূচকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লেনদেনের পরিমাণ। ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন হাজার কোটি ছাড়িয়েছে, সূচক ছাড়িয়েছে পাঁচ হাজারের কোঠাও।

তবে দুর্বল কোম্পানির দৌরাত্ম্য বেড়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ। তিনি বলেন, দুর্বল কোম্পানির দৌরাত্ম্য বেড়ে যাচ্ছে, যা পুঁজিবাজারের জন্য বিপজ্জনক।’ দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ার কারণে পুঁজিবাজারের সূচকও বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। এখনই দুর্বল কোম্পানির দৌরাত্ম্য থামানোর জন্য বিএসইসিকে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

বিএসইসির সৎ নেতৃত্ব ও প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের পুঁজিবাজার বলে মনে করেন ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা ছিল। তিনি পুঁজিবাজারকে নিয়ে সকলকে জিরো টলারেন্সে থাকতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, পুঁজিবাজারে যত রুলস-রেগুলেশনস আছে তার কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। যে যত শক্তিশালী হোক তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ’

তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সুদের হার কমে যাওয়া এবং বর্তমান কমিশনের সৎ ও সাহসী নেতৃত্বের কারণে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা কাটছে, একই সঙ্গে তারল্য বাড়ছে। তাই এই সময়ে কমিশনের উচিত হবে বাজারে ভালো কোম্পানিকে নিয়ে আসা যাতে করে বাজার আরো গতিশীল হয় বলে তিনি জানান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরো লক্ষ্য অর্জন করতে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে; করতে হবে অনেক কাজ। কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করতে আর্থিক দণ্ডের পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে ফৌজদারি দণ্ডের ব্যবস্থাও করতে হবে; যারা পূর্বের নয়-ছয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের চিহ্নিত করতে আগের তদন্ত প্রতিবেদনগুলোর ওপর চোখ বোলাতে হবে। বাংলাদেশের অনেক কোম্পানি ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং পুঁজিবাজারের জন্য আলাদা আলাদা প্রতিবেদন তৈরি করে।

এসব প্রতিবেদনে ভিন্নতা থাকায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কোম্পানি সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি দেখা যায়। এক্ষেত্রে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল দ্বারা অনুমোদিত একটি মাত্র প্রতিবেদন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগ দ্রুত কার্যকর করতে হবে। এখন ব্যাংকে আমানতের সুদের হার ৫-৬ শতাংশ হয়েছে এবং মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় আমানতের সুদের হার অনেক কম হওয়ায় বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে অর্থ বিনিয়োগকে লাভজনক মনে করছে। এ ছাড়া এখনো অনেক স্টক অবমূল্যায়িত আছে। তাই বিনিয়োগের জন্য ভালো সুযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে একটা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এমতাবস্থায় পুঁজিবাজারের এ উত্তরণ ধরে রেখে অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই।