অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল): করোনা নিয়ে আমাদের সাম্প্রতিক আলোচনায় সবকিছু ছাপিয়ে কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভের প্রসঙ্গ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করেছে শীতে সারা বিশ্বে বাড়বে করোনার প্রকোপ এবং সঙ্গে বাংলাদেশেও। এরই মাঝে তার কিছু-কিছু ইঙ্গিতও আমরা দেখতে পাচ্ছি। ইউরোপের যে দেশগুলো কোভিডের ধাক্কা মোটামুটি সামলে উঠেছিল সেসব জায়গায় ক্রমাগতই বাড়ছে কোভিডের নতুন রোগী শনাক্তের হার। নতুন করে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হচ্ছে ইউকে, ফ্রান্স, স্পেন আর জার্মানিতে।

করোনা বেশি বাড়ছে ভারতে। রোগী কিছু-কিছু বাড়তে আরম্ভ করেছে আমাদের হাসপাতালগুলোতেও। এরই প্রেক্ষাপটে করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ মোকাবেলায় ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ পলিসি ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রথম ওয়েভই যখন বাংলাদেশে এখনও ফ্ল্যাট হয়নি, সেখানে দ্বিতীয় ওয়েভ আসবে কিভাবে এ নিয়ে গরম হচ্ছে চায়ের কাপ। একটা সময় ধারণা করা হয়েছিল গ্রীষ্মে কোভিড বিদায় নিবে। কার্যত তা হয়নি। কাজেই শীতে কোভিডের আরেকটি ওয়েভ আসছে শুনলেও তা বিশ্বাস করতে নারাজ অনেকেই।

বাস্তবতাটা হচ্ছে কোভিডের দ্বিতীয় আরেকটি ওয়েভ শীতে বাংলাদেশেও আসতে যাচ্ছে। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, পরীক্ষার সংখ্যা বিবেচনায় নতুন কোভিড রোগী শনাক্তের হারটি কোরবানি ঈদের আগেও এদেশে ছিল ১০ শতাংশের আশপাশে। ঈদের আগে-পরে ব্যাপক সামাজিক মেলামেশার কারণে এটি এক লাফে ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।

ঈদের পরে আমরা স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলায় চরম উদাসীনতা দেখিয়েছি। যে কারণে অনেকদিন ধরেই এদেশে নতুন রোগী শনাক্তের হারটা ২০ শতাংশের উপরে ছিল। সাম্প্রতিক সময় এটি কিছুটা কম এলেও তাতে স্বস্তির কোন সুযোগ নেই। কোভিডের কার্ভটা এদেশে ফ্ল্যাট হতে যাচ্ছে এমনটি প্রত্যাশা করা হবে বোকামি।

আসন্ন শীতকালে যদি বিয়ে-শাদি, পিকনিক, মেলা, ওয়াজ মাহফিল এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা অন্যান্য বছরের মতোই চলতে থাকে, আমরা যতই শারীরিক দূরত্ব মেনে সামাজিকতা করার কথা বলি না কেন, তাতে বিপর্যয় সামলানোর সুযোগ থাকবে সামান্যই। সঙ্গে যোগ হবে শীতে, বিশেষ করে আমাদের নিম্ন-আয়ের মানুষগুলোর বাধ্য হয়ে ছোট্ট ঘরে গাদাগাদি করে থাকার প্রবণতা। তাছাড়া যাদের ফুসফুসের রোগ আছে তাদের সমস্যাগুলো আরও বাড়বে শীতে। আর এ সময় তারা যদি কোভিডে আক্রান্ত হন, তাহলে রোগের গতিপ্রকৃতি খারাপের দিকে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।

শঙ্কার জায়গা আছে আরেকটিও। বিশ্বের দেশে-দেশে আবারও সীমিত পর্যায়ে হলেও যাতায়াত আর যোগাযোগ শুরু হয়েছে। ক্রমেই খুলে যাচ্ছে বিশ্ব। চীনের উহান থেকে রাতারাতি কোভিড ছড়িয়ে পড়েছিল বিমান চলাচলের মাধ্যমেই। এদেশেও কোভিডের আগমন ইতালী প্রবাসী বাংলাদেশীদের হাত ধরে। এখন যখন দেশে-দেশে আবার বাড়ছে কোভিড আর সঙ্গে খুলছে বিশ্ব চলাচল তখন নতুন করে আবারও কোভিডের আমদানি-রফতানি যে খুবই সম্ভব, মাথায় রাখতে হবে সেই বাস্তবতাটাও।

আশার কথা যে এবার আগেভাগেই সচেতন হয়েছে প্রশাসন। দেশে ঢোকার জন্য যাত্রীদের কোভিড টেস্ট থাকা বাধ্যতামূলক হয়েছে। আর রিপোর্ট না থাকলে পাঠানো হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেনটাইনে। বিদেশ ফেরতদের বাসায়-বাসায় হোম কোয়ারেনটাইনে পাঠানোর বিলাসিতা করার সুযোগ এবার আর আমাদের নেই।

ভ্যাকসিনের ব্যাপারেও অগ্রগতি আছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে দেড় কোটি ডোজ ভ্যাকসিন এনে তা সরকারকে সরবরাহ করবে এদেশে সেরাম ইনস্টিটিউটের স্থানীয় প্রতিনিধি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। ভারত এবং বাংলাদেশ সরকার একই দামে পাবে এই ভ্যাকসিন। আর এদেশে ফ্রন্টলাইনাররা তা পাবেন প্রায় বিনামূল্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে।

পাশাপাশি বেসরকারীভাবেও এদেশে ভ্যাকসিন বাজারজাত করবে বেক্সিমকো। এরই মাঝে কোভ্যাক্স-এও নাম লিখিয়েছে সরকার। ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে কোভ্যাক্সের মাধ্যমেও। সঙ্গে আছে জি-টু-জি ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের কাছ থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রাপ্তির বিষয়। তবে মনে রাখতে হবে এখনও কোন ভ্যাকসিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায়নি। আর তা পেলেই যে রাতারাতি দেশের সব মানুষের জন্য ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে ব্যাপারটি তাও নয়। সবচেয়ে বড় কথা এসব ভ্যাকসিন কতদিন কার্যকর থাকবে সেটিও কারও জানা নেই।

আগামী শীতে কোভিড রোগীর সংখ্যা যে এদেশে উর্ধগামী হবে এমনটাই যুক্তিযুক্ত। সরকার তার জায়গা থেকে প্রস্তুতিগুলো নিচ্ছে। তবে যত যাই হোক না কেন, মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া আমাদের জন্য এবারের শীতটা যে খুব কঠিন হবে তা বলাই বাহুল্য। লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ