তৌফিক ইসলাম ও এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজের ডিভিডেন্ডের নামে প্রতারণার অভিযোগ তুলছেন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজের ডিভিডেন্ড প্রতারণার বিষয় বিএসইকে তদন্তের দাবী জানিয়েছেন। ভালো ব্যবসা দেখিয়ে পুঁজিবাজার থেকে উচ্চ দরে শেয়ার ইস্যু করে তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ। তবে এখন সেই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের কোন লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

কোম্পানিটি ব্যবসা সম্প্রসারনের লক্ষ্যে পুঁজিবাজারে এসে নিয়মিত মুনাফায় সংকুচিত হয়েছে। ভালো ব্যবসা দেখিয়ে পুঁজিবাজার থেকে উচ্চ দরে শেয়ার ইস্যু করার পর থেকেই কোম্পানিটির ব্যবসা নিয়মিত নিম্নমূখী। তবে এতোদিন মুনাফায় নিম্নমূখী থাকলেও এবার বড় লোকসানের কবলে পড়েছে কোম্পানিটি। বস্ত্র খাতের কোম্পানি তশরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে ২০১৫ সালে।

কাগজ-কলমে তখন বেশ ভালো ছিল কোম্পানির আর্থিক অবস্থা, যার সুবাদে এই কোম্পানিটি প্রিমিয়াম পায় ১৬ টাকা। সঙ্গে ১০ টাকা অভিহিত দরে প্রতিটি শেয়ারদর দাঁড়ায় ২৬ টাকা। তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ আইপিওতে প্রতিটি শেয়ার ২৬ টাকা করে ইস্যু করে মোট ৬৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা সংগ্রহ করে। এতে প্রতিটি শেয়ারে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ১৬ টাকা।

কিন্তু সেই কোম্পানি ৫ বছরের ব্যবধানে ২০১৯-২০ অর্থবছরের ব্যবসায় বড় লোকসানে পড়েছে। কোম্পানিটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন মহিম হাসান। এছাড়া চেয়ারম্যান হিসেবে রফিক হাসান এবং পরিচালক হিসেবে নাইম হাসান, লিরা রিজওয়ানা হাসান ও আঞ্জুমান আরা বেগম রয়েছেন।

সুত্র মতে, ভালো ব্যবসা দেখিয়ে পুঁজিবাজার থেকে উচ্চ দরে শেয়ার ইস্যু করে তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ। কোম্পানিটি ইস্যুর জন্য অতিরঞ্জিত মুনাফা দেখিয়েছে, অন্যথায় এখন শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে প্রতারনার জন্য ব্যবসায় ধস দেখাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যে কারনে বিভিন্ন কোম্পানির ন্যায় তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজের আর্থিক হিসাব পূণ:নিরীক্ষার দাবি তুলেছেন বিনিয়োগকারীরা।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজের ডিভিডেন্ড প্রতারণার কথা উল্লেখ করে তাদের আর্থিক প্রতিবেদন তদন্তের দাবি জানিয়ে চিঠি দেওয়া হবে। বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি এ.কে.এম মিজান-উর-রশিদ চৌধুরী তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজের ডিভিডেন্ডের প্রতারণা, বিএসইতে চিঠি দিবে বলে জানা গেছে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, কোম্পানিটির অসত্য আর্থিক প্রতিবেদন, দুর্বল করপোরেট গভর্ন্যান্স, লভ্যাংশ প্রদান না করা, রিজার্ভে টাকা রেখে লুটপাট করা, দুর্বল আইপিও অনুমোদন। এ কোম্পানির ডিভিডেন্ড প্রতারণার কারণে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল হচ্ছে। পর্যপ্ত রিজার্ভ থাকা সত্ত্বেও কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিচ্ছে না।

এ বিষয় পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহম্মেদ বলেন, তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজের ডিভিডেন্ডের নামে বিনিয়োগকারেীদের সাথে প্রতারনা করছে। কোনো কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়ার আগে তার আর্থিক অবস্থা ভালো করে যাচাই করা দরকার। তা না হলে একসময় এসব কোম্পানি থেকে ঠকেন বিনিয়োগকারীরা। তিনি আরো বলেন, এ কোম্পানির পরিচালকরা স্বচ্ছ নয়। পরিচালকদের অনৈতিক কার্যকলাপের চিত্র ফুটে উঠছে। যার কারনে নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা।

এ ব্যাপারে কোম্পানির সচিবের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও পাওয়া যায়নি। কোম্পানির টেলিফোন নাম্বারে ফোন করলে বলে আপনারা ফোন করছেন এ বিষয় জানাবো। এরপর আর যোগাযোগ করেনি কোম্পানির সচিব।

আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পুঁজিবাজারে এসে তশরিফা ইন্ডাস্ট্রিজের নিয়মিত মুনাফা সংকুচিত হয়েছে। ভালো ব্যবসা দেখিয়ে পুঁজিবাজার থেকে উচ্চ দরে শেয়ার ইস্যু করার পর থেকেই কোম্পানিটির ব্যবসা নিয়মিত নিম্নমুখী। এ কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে মোট ৬৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা সংগ্রহ করে।

সর্বশেষ ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে এই কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান দেখানো হয়েছে দুই টাকা ৮৭ পয়সা। সেই হিসাবে এ বছর লোকসান দাঁড়িয়েছে ১৯ কোটি টাকার বেশি। এর আগে ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে কোম্পানিটির মুনাফা ছিল আট কোটি ৩৩ লাখ টাকা। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরে মুনাফা নেমে আসে ৭৭ লাখ টাকা।

কোম্পানির এই ধরনের আর্থিক অবস্থার জন্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং করোনাভাইরাসকে দায়ী করছে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। তাদের অভিমত কনোরাভাইরাসের কারণে অন্যান্য খাতের মতো বস্ত্র খাতে ধাক্কা লেগেছে, যা সামাল দিতে পারেনি এ কোম্পানিটি।

এ বিষয় জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোম্পানির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের বড় ক্ষতি হয়েছে। এই সময়ে কিছুদিন আমাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। তাছাড়া বিভিন্ন কারণে প্রতিষ্ঠানের খরচও বেড়েছে। সবকিছু মিলে কোম্পানির ব্যবসা অনেক পিছিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে আমরা এটি কাটিয়ে উঠেছি। আশা করছি আগামী বছর বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো কিছু করতে পারব।’

কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, তশরিফা ইন্ডাস্ট্রিজের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) ২০১৩ সালের দুই দশমিক ৬৪ টাকার শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) থাকলেও পাঁচ বছরের ব্যবধানে সম্পূর্ণ উল্টো অবস্থানে চলে গেছে। সর্বশেষ ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে লোকসান হয়েছে ২.৮৭ টাকা।
এ কোম্পানিটির ইপিএস পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের পর থেকেই নিম্ন ধারায়। দেখা গেছে, ২০১৫-১৬-এর (জানুয়ারি ১৫-জুন ১৬) ১৮ মাসে ইপিএস হয় ৩.০৩ টাকা, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নেমে আসে ১.৩২ টাকায়।

এরপরে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১.২৭ টাকা ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ০.১২ টাকা ইপিএস হয়। এ কোম্পানিটির ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ০.৭২ টাকা, যা দ্বিতীয় প্রান্তিকে ০.২৩ টাকা ও তৃতীয় প্রান্তিকে ১.৮৫ টাকা লোকসান হয়।

এতে করে ৯ মাসে লোকসান হয় ২.৮০ টাকা। আর সর্বশেষ প্রান্তিক মিলে লোকসান দাঁড়িয়েছে ২.৮৭ টাকা। এদিকে করোনার কারণে মূলত এবারই দেশের এক শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার প্রথা চালু হলেও ২৬ টাকা ইস্যু মূল্যের তশরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ গত অর্থবছরেই এক শতাংশ লভ্যাংশে নেমে আসে। আর এবার বড় লোকসানে কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি।

এদিকে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে পুঁজিবাজারে এ শেয়ারের চাহিদাও অনেক কমে গেছে। যে কারণে শেয়ারদরও অনেক কম পরিলক্ষিত হচ্ছে। ২৬ টাকা ইস্যু মূল্যের শেয়ার বর্তমানে ১১ টাকার কমে লেনদেন হচ্ছে। অর্থাৎ যারা বেশি দরে এ কোম্পানির শেয়ার কিনেছিলেন তাদের এর মাশুল দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে অধিক প্রিমিয়াম নিয়ে যারা বাজারে এসেছিল, তাদের বেশিরভাগ কোম্পানির আর্থিক অবস্থা এখন আগের মতো নেই। দরটা ইস্যু মূল্য থেকে নেমে গেছে। প্রায় সব কোম্পানির বিনিয়োগকারীই প্রিমিয়ামের মাশুল দিচ্ছেন।