এম মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আইনি জটিলতায় পড়েছে তৈরী পোশাক রফতানির অপরিহার্য পণ্য কার্টন, লেভেল, বার্টন ও পলিব্যাগ শিল্প। করোনাভাইরাসের প্রভাবে প্রায় চার মাস উৎপাদন বন্ধ থাকায় রফতানি আয় কমে গেছে। এত আইনি বাধ্যবাধকতায় বর্ধিত হারে এ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। এতে তৈরী পোশাকের রফতানির চাহিদা অনুযায়ী কার্টন ও লেভেল উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এতে সামগ্রিক রফতানিই হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প খাতকে সচল রাখতে সরকার লক্ষাধিক কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল। সরকারের প্রণোদনা নিয়ে অনেক খাতই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এ থেকে বাদ যায়নি তৈরী পোশাক রফতানির অপরিহার্য পণ্য কার্টন, লেভেল, বার্টন ও পলিব্যাগ শিল্প। এ দিকে করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব ও লকডাউনের কারণে প্রায় চার মাস পণ্য উৎপাদন বন্ধ ছিল।

এতে অন্যান্য খাতের মতো তৈরী পোশাক রফতানির সহযোগী এসব শিল্পের রফতানি আয়ও কমে যায়। এ দিকে কাস্টমস আইন অনুযায়ী এক বছরে যে পরিমাণ রফতানি আয় হবে পরের বছর রফতানি আয়ের অতিরিক্ত ২০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে পারবে। যেমন, রফতানি আয়ের প্রাপ্যতা অনুযায়ী একজন ব্যবসায়ী ১০০ টন পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করতে পারতেন।

পরের বছর যে পরিমাণ রফতানি আয় বাড়বে তার অতিরিক্ত আরো ২০ শতাংশ পণ্য আমদানি করতে পারবেন। আগের বছর ১০০ টন কাঁচামাল আমদানি করে পণ্য উৎপাদন করা হলো এবং সে অনুযায়ী রফতানিও করা হলো পরের বছর আইন অনুয়ায়ী পরের বছর ১২০ টন আমদানির সুযোগ পাবেন। এতে বর্ধিত হারে পণ্য উৎপাদনের সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা।

এ খাতের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রায় চার মাস ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকায় গত অর্থবছরের রফতানি আয় আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে। এর ফলে আগে যেখানে ১০০ টন পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করতে পারতেন, রফতানি আয় কমে যাওয়ায় এবার তাদের প্রাপ্যতাও কমে গেছে। এতে এ বছর বর্ধিত হারে পণ্যের কাঁচামাল আমদানির পরিবর্তে আগের বছরের চেয়ে কম পণ্য আমদানির সুযোগ পাচ্ছেন।

বর্ধিত হারে পণ্যের কাঁচামাল আমদানির জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তা সময়সাপেক্ষ। আগে যেখানে একবার প্রাপ্যতা অনুযায়ী বর্ধিত হারে কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দেয়া হতো, এখন তা বারবার অনুমোদনের জন্য কাস্টস কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হবে।

ফলে সময় মতো তৈরী পোশাকের অপরিহার্য এসব সহযোগী পণ্য সরবরাহ করা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে। এসব সহযোগী পণ্য সময়মতো সরবরাহ করতে না পারলে তৈরী পোশাক রফতানিই হুমকির মুখে পড়ে যাবে বলে এ খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন।

জানা গেছে, তৈরী পোশাক রফতানিতে অন্যতম অপরিহার্য পণ্য হলো কার্টন, লেভেল, বার্টন এবং পলিব্যাগ। ৮০ দশকে এ দু’টি পণ্য আমদানি করতে হতো। এতে রফতানি আয়ের বড় একটি অংশ বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশে চলে যেতো। কিন্তু ধীরে ধীরে অপরিহার্য এ দু’টি পণ্য উৎপাদনের জন্য দেশেই শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে। জানা গেছে, তৈরী পোশাক রফতানিতে এসব পণ্য উৎপাদনের জন্য দেশে গড়ে উঠেছে প্রায় দুই হাজার শিল্পকারখানা।

আর এর সাথে প্রায় ৮ লাখ শ্রমিক কর্মচারী জড়িত রয়েছেন। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে তৈরী পোশাকশিল্পের সাথে আলোচিত সহযোগী শিল্পগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তৈরী পোশাকের অর্ডার বন্ধ ও বাতিল হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে কার্টন ও লেভেল প্যাকেজিং শিল্পেরও কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অনেক বিলও আটকে যায়। এ দিকে আগে যেসব পণ্য উৎপাদন করা হয়েছিল তা গোডাউনে মজুদ থাকে।

জুনের পর যখন পোশাক রফতানি বেড়ে যায় তখন মজুদ এসব সহযোগী পণ্যও ব্যবহৃত হয়। এখন তাদের মজুদ আর কোনো পণ্য নেই। এ দিকে তৈরী পোশাক রফতানি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এসব সহযোগী শিল্পের চাহিদাও বেড়ে গেছে। কিন্তু কাঁচামাল আমদানির প্রাপ্যতা কমে যাওয়ায় উদ্যোক্তারা বর্ধিত হারে পণ্য সরবরাহ করতে পারছেন না।

বাংলাদেশ লেভেল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএমইএ) প্রেসিডেন্ট আহসান সাহেদ খান জানিয়েছেন, সরকার নানাভাবে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দিচ্ছে; কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে তারা পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে বেকায়দায় পড়ে যাচ্ছেন। করোনার প্রভাবে পণ্য উৎপাদন বন্ধ থাকায় গেল বছর তাদের রফতানি আয়ও কম হয়েছে।

এতে আইনের বাধ্যবাধকতায় তাদের এবার কাঁচামাল আমদানির অনুমোদনও কমে গেছে। কাস্টমসের কাছে আবেদন করার সুযোগ আছে; কিন্তু সেটি অনুমোদন পেতে কালক্ষেপণ হয়। এতে সময়মতো তৈরী পোশাক রফতানির জন্য সহযোগী এসব পণ্য সরবরাহ করায় জটিলতা দেখা দিচ্ছে। এতে সামগ্রিক রফতানি হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা নিরসনের জন্য তিনি করোনার সময়ের উৎপাদনকে হিসাবে না নিয়ে আগের বছরের প্রাপ্যতা অনুযায়ী কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দেয়ার অনুরোধ করেছেন। অন্যথায় পোশাক রফতানি হুমকির মুখে পড়ে যাবে।

তিনি বলেন, এসব সহযোগী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির প্রথমে অনুমোদন দেয়া হয় মূলধনী যন্ত্রপাতির উৎপাদন সক্ষমতার ওপর বিবেচনা করে। কোনো কারণে এক বছর ব্যবসা খারাপ হলে পরের বছর কাঁচামাল আমদানির প্রাপ্যতাও কমে যায়। তিনি মনে করেন, আইনি এসব জটিলতা নিরসনে প্রথমে শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতার সক্ষমতা অনুযায়ী কাঁচামাল আমদানির যে পরিমাণ অনুমোদন দেয়া হয় তা বহাল রাখলে ভালো হবে। এতে কারো ব্যবসা খারাপ হলে পণ্য আমদানি কম করবে।

আর ভালো হলে উৎপাদন সক্ষমতা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করবে। এতে বিদ্যমান জটিলতাও নিরসন হবে বলে তিনি মনে করেন। এ ক্ষেত্রে পণ্য আমদানি মূল্যের সাথে কাস্টমস নির্ধারিত মূল্য সংযোজন সামঞ্জস্য আছে কি না তা কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করতে পারে। এতে বিদ্যমান জটিলতা আর থাকবে না। ব্যবসা খারাপ হলেও পরের বছর বর্ধিত হারে পণ্য আমদানির জন্য আবেদনের প্রয়োজন হবে না বলে তিনি মনে করেন।