দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আরামিট সিমেন্ট লিমিটেড সহযোগী প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭৭ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার মাধ্যমে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করেছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) জারি করা ২০০৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আইন লঙ্ঘন করেছে কোম্পানিটি।

ডিভিডেন্ড না দিয়ে বরং সহযোগী প্রতিষ্ঠানে সুদবিহীন ঋণের বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে আরামিট সিমেন্টে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ইতিমধ্যে সে চিঠি কোম্পানির কাছে পৌছেছে। এছাড়া আজ-কালের মধ্যে চিঠির ব্যাখ্যা দিতেও প্রস্তুত রয়েছে আরামিট সিমেন্ট কর্তৃপক্ষ।

এ ব্যাপারে আরামিট সিমেন্টের চীফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) মোহাম্মদ শাহ আলম জানান, এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চিঠি পেয়েছি। আগামী দু-একদিনের মধ্যে আমরা কমিশনকে এই চিঠির ব্যাখ্যা দিবো।

উল্লেখ্য, পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি আরামিট সিমেন্ট লিমিটেড গত ৪ বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের কোন ডিভিডেন্ড দেয়নি, কিন্তু গত ৫ বছর ধরে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করে সহযোগী প্রতিষ্ঠানে সুদবিহীন ঋণ দিয়েছে কোম্পানিটি। ২০০৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিএসইসির জারি করা আইন লঙ্ঘন করে আরামিট সিমেন্ট লিমিটেড সহযোগী প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। যা সম্পূর্ণ সুদবিহীন।

গত ৫ বছর কোম্পানিটি তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে কোন ধরণের সুদ ছাড়াই ঋণ দিয়ে রেখেছে। সহযোগী প্রতিষ্ঠানে দেওয়া ঋণ থেকে মাত্র ১০ শতাংশ সুদ নিলেও বিনিয়োগকারীদের ২০ শতাংশ ডিভিডেন্ড দিতে পারতো আরামিট সিমেন্ট। নিজেদের স্বার্থ ঠিক রেখে বিনিয়োগকারীদের বছরের পর বছর ঠকিয়ে আসছে কোম্পানিটি।

গত ১৩ আগস্ট সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ঋণের তথ্য চেয়ে তালিকাভুক্ত সকল কোম্পানিতে চিঠি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিকভাবে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর পরিচালকদের মালিকানায় থাকে।

৩১ মার্চ পর্যন্ত কোম্পানিটি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৪৩৩.৮৩ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। এই টাকার জন্য ২৯.৮১ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে অ্যারামিট। অ্যারামিট সিমেন্ট ঋণ পরিশোধ করলেও কোন ধরণের সুদ ছাড়া অ্যাসোসিয়েট কোম্পানিতে ঋণ দিয়েছে কোম্পানিটি। অ্যাসোসিয়েট কোম্পানিতে সুদ বিহীন ঋণ দিলেও ৩০ জুন,২০২০ সমাপ্ত হিসাব বছর শেষে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোন ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেনি পরিচালা পর্ষদ।

সুদবিহীন ঋণ দেয়া সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- অ্যারামিট থাই অ্যালমোনিয়ামে ২৭.৬৪ কোটি টাকা, অ্যারামিট পাওয়ারে ৫.৮৪ কোটি টাকা, অ্যারামিট ফুটওয়্যারে ২৬.৫৩ কোটি টাকা, অ্যারামিট অলো কম্পোজিট প্যানেলে ১.২৫ কোটি টাকা এবং নর্থ সাউথ ট্রান্সপোর্টে ১৫.৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অ্যারামিট সিমেন্ট লিমিটেড।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রামভিত্তিক পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি আরামিট সিমেন্ট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের ব্যর্থতা, যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা, হিসাব সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি ও আর্থিক অপব্যবস্থাপনায় বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত ব্যাংকঋণ নির্ভরতা।

সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে মোট ব্যাংকঋণের পরিমাণ ছিল ৪৭৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, যা আগের অর্থবছরের ছিল ৩৯৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকঋণ বেড়েছে ৮১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর গত অর্থবছর শেষে কোম্পানিটির ব্যাংকঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় পরিশোধিত মূলধনের তুলনায় ১৪ গুণ বেশি। আর ঋণের সুদ পরিশোধ ও বকেয়া আদায়ে ব্যর্থতায় আরামিট সিমেন্ট গত চার অর্থবছর ধরে লোকসানে রয়েছে। একইসঙ্গে বন্ধ রয়েছে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদান। ফলে কোম্পানিটির বিনিয়োগকারীরা লোকসানের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

জানা যায়, আরামিট গ্রুপের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সিমেন্ট, পাওয়ার, ফুটওয়্যার, থাই অ্যালুমিনিয়ামসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে। এ গ্রুপের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান আরামিট সিমেন্ট লিমিটেড। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনায় রয়েছে বেসরকারি ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান রুকমিলা জামান চৌধুরী।

চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকায় অবস্থিত সিমেন্ট খাতের এ কোম্পানিটি পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত হয় ১৯৯৮ সালে। কিন্তু গত কয়েক বছরের প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের ব্যর্থতা, যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা, হিসাব সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি ও আর্থিক অপব্যবস্থাপনায় ডুবছে। কোম্পানিটির ৩৩ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের ব্যবসা পরিচালনায় বাড়ছে ব্যাংকঋণ নির্ভরতা। এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে ৮১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। গত ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে মোট ব্যাংকঋণ ছিল ৪৭৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।

এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল ৪২২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৩৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদ ২১ কোটি তিন লাখ টাকা। আগের অর্থবছর মোট ঋণ ছিল ৩৯৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল ৩৩৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৩৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদ ১৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির ফাইন্যান্সিয়াল লিভারেজ ১৪ গুণ।

অন্যদিকে গত চার অর্থবছর ধরে আরামিট সিমেন্ট লোকসানে রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরের নিট লোকসান হয়েছে ২৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা। একইভাবে আগের অর্থবছরের (২০১৮-১৯) নিট লোকসান হয়েছিল ১৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ছিল ১৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ১০ কোটি ছয় লাখ টাকা। অর্থাৎ চার বছরের নিট লোকসানের পরিমাণ ৬৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। একইসঙ্গে বন্ধ রয়েছে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদান।

আর্থিক অপব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ব্যর্থতার নেতিবাচক চিত্র পাওয়া যায় প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদনে, চার বছরের আগের তুলনায় বর্তমানে উৎপাদন ও বিক্রয় দ্বিগুণের বেশি বাড়লেও লোকসানের পাল্লা তার চেয়ে ১০ গুণ। আর গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লোকসানের কারণে কোম্পানিটির ইকুইটি কমেছে ১৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

কোম্পানিটির ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক হিসাব অনুসারে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ শেষে আরামিট সিমেন্ট লিমিটেড ব্যবসা পরিচালনা করে নিট লোকসান করেছে তিন কোটি ৯ লাখ টাকা, যা আগের বছরের ছিল এক কোটি ৯৬ লাখ টাকা। পাশাপাশি একই সময়ে সিমেন্ট বিক্রয়ের অর্থ বকেয়া দাঁড়িয়েছে ২৪৪ কোটি টাকা। আর বিপুল পরিমাণে বকেয়া পাওনা আদায়ে গত কয়েক বছর ধরে দায়িত্বশীলরা কোনো সাফল্য দেখাতে পারছে না। কিন্তু এই ব্যবসায়িক মন্দাবস্থার কোম্পানিটি থেকে পরিচালনা পর্ষদও ব্যবসা সম্প্রসারণ কিংবা সংকট উত্তরণে পথ দেখাতে পারছে না। এতে হতাশ বিনিয়োগকারীরা।

আরামিট সিমেন্টের অব্যাহত লোকসান বিষয়ে কোম্পানির সচিব কামরুজ্জামান বলেন, ‘গত তিন অর্থবছর ধরে আমরা লোকসানে আছি। মূলত ব্যাংকঋণের উচ্চসুদ, করোনাভাইরাসের প্রভাব এবং আগাম শুল্ককর জটিলতার কারণে লোকসান হয়েছে। তবে এখন তো ব্যাংকঋণের সুদ ৯ শতাংশ হবে, তখন আমাদের আবার মুনাফা হবে। এছাড়া বাজারের অসুস্থ প্রতিযোগিতা তো আছে। অনেক কোম্পানি আমাদের চেয়ে কম দামে সিমেন্ট বিক্রয় করছে।’

পুরোনো স্থাপনা কিংবা প্রযুক্ত হওয়ায় কি লোকসানের কারণ? এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘আসলে আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ১৭০০ মেট্রিক টন। ফলে উৎপাদন সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার হওয়ায় ব্যয় বেড়েছে। অন্যদিকে অন্যান্য কোম্পানিগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা বেশি। কিন্তু উৎপাদন কম। ফলে তাদের ব্যয় কম হচ্ছে। আশা করছি, চলতি অর্থবছরের মুনাফা হবে।’

উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে শেয়ারবাজারে আসা এ কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন ৫০ কোটি ও পরিশোধিত মূলধন ৩৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে উদ্যোক্তা-পরিচালক ৪৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ১৪ দশমিক ৮৩ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে বাকি ৩৮ দশমিক ০৩ শতাংশ শেয়ার। গতকাল কোম্পানিটির শেয়ার ১৫ টাকা ২০ পয়সা থেকে ১৬ টাকায় মাত্র আট হাজার ১৯৫টি কেনাবেচা হয়। আর এক বছরের সর্বনিš§ দর ছিল ১০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২২ টাকা।