স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সর্বনিম্ন মুনাফা শেয়ারপ্রতি মাত্র ৪ পয়সা নিয়ে যুক্ত হচ্ছে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে চাঁদা সংগ্রহ শুরু করা মোবাইল অপারেটর রবি আজিয়াটা লিমিটেড। কোম্পানিটি গ্রামীণফোনের আগে ব্যবসা শুরু করলেও মাঝেমধ্যেই লোকসান গুণে। এরমধ্য দিয়েই পুঁজিবাজারের ইতিহাসে আইপিওতে সর্বনিম্ন মুনাফা নিয়ে সর্বোচ্চ শেয়ার ইস্যু করবে রবি।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত গ্রামীণফোনের (জিপি) থেকে ২৬৬১ কোটি টাকারও বেশি সম্পদ রয়েছে আরেক মোবাইল অপারেটর কোম্পানি রবি আজিয়াটার। তারপরেও কোম্পানিটিকে দীর্ঘ ২৫ বছরের পথচলার পরে এসে মুনাফা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জিপি যেখানে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করছে, সেখানে রবিকে লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পেতে লড়াই করতে হচ্ছে। কোম্পানি দুটির ২০১৯ সালের আর্থিক হিসাব বিশ্লেষনে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

ব্যবসায় দূর্বল এ কোম্পানিটিকে পুঁজিবাজারে আনতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এরইমধ্যে পাবলিক ইস্যু রুলসের কয়েকটি শর্ত পরিপালন থেকে অব্যাহতিও দিয়েছে। পুঁজিবাজার থেকে টাকা সংগ্রহের অপেক্ষায় থাকা মোবাইল অপারেটর কোম্পানি রবি আজিয়াটার ২০১৯ সালে শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে মাত্র ৪ পয়সা।

আর শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ (এনএভিপিএস) রয়েছে ১২.৬৪ টাকার। এই অবস্থার মধ্য দিয়ে কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে বড় অর্থ সংগ্রহের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের প্রক্রিয়ায় থাকা রবির নিরীক্ষত খসড়া প্রসপেক্টাস থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, রবির নামের যে খ্যাতি রয়েছে, সেই তুলনায় ভালো নেই প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা। কোম্পানিটির আয়-মুনাফায়ও কোনো ধারাবাহিকতা নেই, যে কারণে এই কোম্পানিটিতে বিনিয়োগ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বাজারে এসে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

রবি আজিয়াটার আর্থিক বিবরণীতে দেখা যায়, সর্বশেষ পাঁচ বছরের মধ্যে দুই বছর লোকসানে ছিল কোম্পানিটি। এর মধ্যে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে লোকসানে ছিল। ২০১৬ সালে এ প্রতিষ্ঠানটি লোকসান করে ৬৯৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। পরের বছর লোকসান কমে দাঁড়ায় ১০ কোটি ৪৬ লাখ টাকায়। পরে ব্যবসায়িকভাবে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়ে লাভে ফিরে আসে কোম্পানিটি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে কোম্পানিটি মুনাফা করে ১৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর আগের বছর (২০১৮ সালে) মুনাফা ছিল ২১৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০১৯ সালে আগের চেয়ে মুনাফা অস্বাভাবিকহারে কমে গেছে।

যদিও ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটির আয় বেড়েছে। এ সময় কোম্পানিটির রাজস্ব আয় দাঁড়ায় সাত হাজার ৪৮১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৭৯৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা। তবে ২০১৮ সালে রবির আয় কমে যায়। ২০১৭ সালে কোম্পানিটির আয় ছিল ছয় হাজার ৮২৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৬ সালেও কোম্পানিটির আয় কমে।

যদিও করোনার কারণে চলতি বছর কোম্পানিটির আয় ও মুনাফা কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, কোম্পানিটি যদি কোনো কারণে আবারও ব্যবসায় খারাপ করে তাহলে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা পূরণে বেগ পেতে হবে।

এ বিষয় জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাজার বিশ্লেষক বলেন, আর্থিক অবস্থার বিবেচনায় কোম্পানিটি খুব ভালো অবস্থানে নেই। তবে বহুজাতিক কোম্পানি হিসেবে এর সুনাম রয়েছে। এই ধরনের কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্তির প্রয়োজন আছে। প্রতিষ্ঠানটি যদি বাজারে এসে ভালো ব্যবসা করতে পারে, তাহলে হয়তো তারা বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে।

দেখা গেছে, রবি আজিয়াটার ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ দাড়াঁয় ১৫ হাজার ৪৩৪ কোটি ৭১ লাখ টাকায়। যার পরিমাণ গ্রামীণফোনে ছিল ১২ হাজার ৭৭৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এ হিসাবে রবি এগিয়ে ২ হাজার ৬৬১ কোটি ১৮ লাখ টাকা বা ২১ শতাংশ। এসত্ত্বেও ২০১৯ সালে রবির মুনাফা হয়েছে ১৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা। যার পরিমাণ জিপির ছিল ৩ হাজার ৪৫১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

দেখা গেছে, কোম্পানিটির ২০১৯ সালে করপূর্ব মুনাফা হয়েছিল ৩৭৮ কোটি ৯০ লাখ ৭ হাজার টাকা। যা শেয়ারপ্রতি হিসেবে হয় ৮০ পয়সা। আর স্বাভাবিক কর হার ৪৫ শতাংশ (টার্নওভার ট্যাক্স ছাড়াই) বিবেচনায় মুনাফা হয় ২০৮ কোটি ৩৯ লাখ ৫৩ হাজার টাকা বা ইপিএস ৪৪ পয়সা। আর তালিকাভুক্ত গ্রামীণফোনের ন্যায় ৪০ শতাংশ কর হার বিবেচনায় মুনাফা হয় ২২৭ কোটি ৩৪ লাখ ৪ হাজার টাকা বা ইপিএস ৪৮ পয়সা।

গ্রামীণফোনের কাছে গত ৩১ ডিসেম্বর নিট সম্পদের (দায় বাদে) পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৮৩৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকার। একইসময়ে রবির কাছে ছিল ৫ হাজার ৯৫৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে রবি ২ হাজার ১২৪ কোটি ১৫ লাখ টাকার বেশি নিট সম্পদ ছিল। তারপরেও কোম্পানিটি টার্নওভার হয় জিপির অর্ধেক। এক্ষেত্রে অর্ধেক হলেও মুনাফা হয়েছিল মাত্র ০.৪৯ শতাংশ।

এক শীর্ষস্থানীয় মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা (সিইও) বলেন, রবির সম্পদের তুলনায় মুনাফা করতে এখনো লড়াই করাটা অস্বাভাবিক এবং হতাশার। জিপির থেকে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদ নিয়েও বর্তমান পরিস্থিতি জন্য ম্যানেজমেন্টের অদক্ষতা দায়ী। এছাড়া অভ্যন্তরীন অন্য কোন বিষয় থাকতে পারে, যা প্রকাশ করছে না। তাই বলে ট্যাক্সের হার বেশি বলে নামমাত্র মুনাফা হওয়ার যে ব্যাখ্যা দেয়, তা গ্রহণযোগ্য না। কারন কোম্পানিটির ট্যাক্স প্রভিশনিং পূর্ব মুনাফাই দূর্বল।

সম্পদের তুলনায় রবি টার্নওভারে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। মোবাইল অপারেটর শিল্পের সম্পদের সমপরিমাণ টার্নওভার হলেও রবির তা ৪৭ শতাংশ। এছাড়া সম্পদ ব্যবহারের তুলনায় মুনাফার হার শিল্পের ক্ষেত্রে ২৪ শতাংশ হলেও রবির মাত্র ০.১১ শতাংশ। এই শিল্পের অপারেটিং প্রফিট রেশিও যেখানে ৪৬ শতাংশ, সেখানে রবির হার ১১.৫৭ শতাংশ।

আর নিট প্রফিট রেশিও শিল্পের ২৪ শতাংশ হলেও রবির মাত্র ০.২৩ শতাংশ। এছাড়া ইক্যুইটি বা নিট সম্পদ ব্যবহারের তুলনায় শিল্পের মুনাফার হার ৯২ শতাংশ হলেও রবির মাত্র ০.২৮ শতাংশ। অন্যদিকে মোবাইল অপারেটর শিল্পের শেয়ারপ্রতি নিট নগদ প্রবাহ যেখানে ৪২.৫০ টাকা, সেখানে রবির মাত্র ৬.১০ টাকা।

রবি সম্পদে এগিয়ে থাকলেও নগদ টাকায় পিছিয়ে। এ কোম্পানিটির হাতে ৩১ ডিসেম্বর নগদ টাকা ছিল ৪৫১ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং স্বল্পমেয়াদি এফডিআর ছিল ৩৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। আর জিপির কাছে একইসময় নগদ টাকা ছিল ১ হাজার ৩৭৬ কোটি ৭ লাখ টাকা। যে কারনে বিনিয়োগসহ যেকোন প্রয়োজনে রবির চেয়ে জিপির কাজ করাটা সহজ।

রবি আজিয়াটা ১৯৯৫ সালের ২২ অক্টোবর গঠিত হয় এবং একইদিনে ব্যবসা শুরু করে। আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত গ্রামীণফোন গঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১০ অক্টোবর। এই ১ বছর পরে গঠিত হয়েও গ্রামীণফোন এখন বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে। আর রবি আজিয়াটা এখনো লোকসান থেকে মুনাফা করতে লড়াই করে যাচ্ছে। অথচ গ্রামীণফোনের থেকে রবির রয়েছে কয়েকগুণ বেশি পরিশোধিত মূলধন রয়েছে।

প্রসপেক্টাস অনুযায়ি, ৪ হাজার ৭১৪ কোটি ১৪ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনের রবির ২০১৯ সালে টার্নওভার হয়েছে ৭ হাজার ৪৮১ কোটি ১৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। এই টার্নওভার থেকে সব ব্যয় শেষে নিট মুনাফা হয়েছে মাত্র ১৬ কোটি ৯০ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। যা শেয়ারপ্রতি হিসেবে মাত্র ৪ পয়সা। এর আগে ২০১৮ সালে রবির ইপিএস হয়েছিল ৪৬ পয়সা। তবে ২০১৭ সালে শেয়ারপ্রতি ২ পয়সা ও ২০১৬ সালে ১ টাকা ৮৮ পয়সা লোকসান হয়েছিল।

অপরদিকে পুঁজিবাজারে একমাত্র মোবাইল অপারেটর কোম্পানি হিসেবে ২০০৯ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া গ্রামীণফোনের বর্তমানে পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১ হাজার ৩৫০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এই মূলধনের কোম্পানিটির ২০১৯ সালে শেয়ারপ্রতি ২৫.৫৬ টাকা হিসাবে নিট মুনাফা হয়েছে ৩ হাজার ৪৫১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর শেয়ারপ্রতি সম্পদ রয়েছে ২৮.৪০ টাকা। অভিহিত মূল্যে অর্থাৎ প্রতিটি ১০ টাকায় ৫২ কোটি ৩৭ লাখ ৯৩ হাজার ৩৩৪টি শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৫২৩ কোটি ৭৯ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪০ টাকা সংগ্রহ করবে রবি।

রবির নতুন শেয়ারের মধ্যে ৩৮৭ কোটি ৭৪ লাখ ২৪ হাজার টাকার শেয়ার আইপিওতে ইস্যু করা করা হচ্ছে বিনিয়োগকারিদের জন্য। বাকি ১৩৬ কোটি ৫ লাখ ৯ হাজার ৩৪০ টাকার শেয়ার ইস্যু করা হবে কোম্পানির কর্মচারীদের জন্য।

ব্যবসায় মন্দার কারণ হিসেবে রবি আজিয়াটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মাহতাব উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ২০১৯ সালে অতিরিক্ত কর আরোপের কারণে ৯৫ শতাংশ সঞ্চিতি গঠন করতে হয়েছে। ওই বছরে টার্নওভার ট্যাক্স ০.৭৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ শতাংশ করায় এমনটি করতে হয়েছে। আমরা আইপিও’র শর্ত হিসেবে এই টার্নওভার ট্যাক্স কমিয়ে অন্যান্যদের সমান করার কথা বলেছি।

এদিকে রবির কর সঞ্চিতি পুরোটা বাদ দিলেও ২০১৯ সালে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ৮০ পয়সা। দেখা গেছে, কোম্পানিটির ২০১৯ সালে করপূর্ব মুনাফা হয়েছিল ৩৭৮ কোটি ৯০ লাখ ৭ হাজার টাকা। যা শেয়ারপ্রতি হিসেবে হয় ৮০ পয়সা। আর স্বাভাবিক কর হার ৪৫ শতাংশ (টার্নওভার ট্যাক্স ছাড়াই) বিবেচনায় মুনাফা হয় ২০৮ কোটি ৩৯ লাখ ৫৩ হাজার টাকা বা ইপিএস ৪৪ পয়সা। আর তালিকাভুক্ত গ্রামীণফোনের ন্যায় ৪০ শতাংশ কর হার বিবেচনায় মুনাফা হয় ২২৭ কোটি ৩৪ লাখ ৪ হাজার টাকা বা ইপিএস ৪৮ পয়সা।

কোম্পানিটির বর্তমানে ৪ হাজার ৭১৪ কোটি ১৪ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধন রয়েছে। এই মূলধনের কোম্পানিটির নিট সম্পদ রয়েছে ৫ হাজার ৯৫৮ কোটি ৮৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকার। এ হিসাবে কোম্পানিটিতে শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ (এনএভিপিএস) দাড়িঁয়েছে ১২.৬৪ টাকায়।

পুঁজিবাজারে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি পরিশোধিত মূলধন রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ২ হাজার ৯২০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। রবি তালিকাভুক্ত হলে এটি হবে সর্বোচ্চ পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি। কোম্পানিটির বর্তমান ৪ হাজার ৭১৪ কোটি ১৪ লাখ টাকাসহ আইপিও পরবর্তী মূলধন বেড়ে দাঁড়াবে ৫ হাজার ২৩৭ কোটি ৯৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫০ টাকায়। যা হবে গ্রামীণফোনের প্রায় ৪ গুণ।