স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: করোনাভাইরাস মহামারীতে কয়েক মাসের অর্থনৈতিক অচলাবস্থা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকিং খাতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি; জুলাই-সেপ্টেম্বর শেষে প্রায় সবগুলো ব্যাংক মুনাফায় রয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তৃতীয় প্রান্তিকের আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ২৯টি ব্যাংকের সবকটির মুনাফার চিত্র এসেছে। এর মধ্যে ১৯টি ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি মুনাফা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে।

মুনাফা বেড়েছে যেসব ব্যাংকের: তৃতীয় প্রান্তিকে এবি ব্যাংক শেয়ারপ্রতি ১১ পয়সা মুনাফা দেখিয়েছে, যা আগের চেয়ে ২৬৭ শতাংশ বেশি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ২৯ পয়সা, যা আগের একই সময়ের চেয়ে ৬১ শতাংশ বেশি।

ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের তৃতীয় প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ’২০) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র মতে, তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ’২০) কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ১ টাকা ৭০ পয়সা। গত অর্থবছরের একই সময়ে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) ৮৮ পয়সা।

সর্বশেষ ৯ মাসে (জুলাই,১৯-মার্চ’২০) কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৩ টাকা ৬৪ পয়সা। গত অর্থবছরের একই সময়ে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) ২ টাকা ৮৩ পয়সা। একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি সম্পদ (এনএভি) হয়েছে ৩৫ টাকা ৮৪ পয়সা।

আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি ৫০ পয়সা মুনাফা করেছে, যেখানে আগের একই সময় ২৭ পয়সা লোকসান ছিল। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ১ টাকা ৩৫ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৬৩ শতাংশ বেশি। ব্র্যাক ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ১ টাকা ১৩ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের চেয়ে ৭৭ শতাংশ বেশি। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ২ টাকা ১ পয়সা যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশ কম।

দ্য সিটি ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ১ টাকা ৯৯ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের তুলনায় ১৬২ শতাংশ বেশি। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ৩ টাকা ৪ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি। ঢাকা ব্যাংক তিন মাসে ৫২ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ১ টাকা ৩৬ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি।

এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ৪৩ পয়সা মুনাফা করেছে, যেখানে আগের বছর এই সময় শেয়ারপ্রতি ১২ পয়সা লোকসান ছিল। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ১ টাকা ৪৩ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২৫ শতাংশ বেশি। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ৫১ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের বছর এই সময় তাদের মুনাফা ৩২ পয়সা ছিল। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ১ টাকা ৩৩ পয়সা, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি।

আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ১৭ পয়সা মুনাফা করেছে, যেখানে আগের বছর এই সময় ২০ পয়সা লোকসান ছিল। নয় মাসে লোকসান হয়েছে ১৫ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭০ শতাংশ কম। ইসলামী ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ৩৬ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের তুলনায় ১৫৭ শতাংশ বেশি। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ২ টাকা ৩০ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি।

মার্কেন্টাইল ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ৬৫ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের তুলনায় ৪১ শতাংশ বেশি। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ১ টাকা ৭২ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ শতাংশ কম। ওয়ান ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ২৪ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি। ব্যাংকটি নয় মাসে মুনাফা করেছে ১ টাকা ২১ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮৬ শতাংশ বেশি।

প্রিমিয়ার ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ৫৪ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের তুলনায় ৩৮ শতাংশ বেশি। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ১ টাকা ৫১ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ শতাংশ কম। প্রাইম ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ৪৫ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ৯৩ পয়সা যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩১ শতাংশ কম।

পূবালী ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ১ টাকা ৫০ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের চেয়ে ১৬৮ শতাংশ বেশি। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ২ টাকা ৯৪ পয়সা যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ৪৯ পয়সা মুনাফা করেছে যা আগের তুলনায় ৭৫ শতাংশ বেশি। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ১ টাকা ৫৪ পয়সা যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি।

সাউথইস্ট ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ৭৫ পয়সা মুনাফা করেছে যা আগের তুলনায় ২৯ শতাংশ বেশি। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ২ টাকা ৩৯ পয়সা যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ শতাংশ কম। ট্রাস্ট ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ২ টাকা ৮ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের তুলনায় ১৩৬ শতাংশ বেশি। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ৪ টাকা ৮ পয়সা যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৯ শতাংশ বেশি।

ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ৭৩ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের তুলনায় ৪ শতাংশ বেশি। আগের বছর এ সময় মুনাফা ৭০ পয়সা ছিল। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ১ টাকা ৪৫ পয়সা যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ শতাংশ কম।

উত্তরা ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ১ টাকা ৪১ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের তুলনায় ১৮২ শতাংশ বেশি। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ৩ টাকা ৪ পয়সা যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি।

মুনাফা কমেছে যেসব ব্যাংকের: ব্যাংক এশিয়া তৃতীয় প্রান্তিকে ৬০ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের তুলনায় ৩২ শতাংশ কম। তবে নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ১ টাকা ৯৭ পয়সা যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি।

ব্যাংক এশিয়া তৃতীয় প্রান্তিকে ২ টাকা ৩৫ পয়সা মুনাফা করেছে যা আগের তুলনায় ১১ শতাংশ কম। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ৬ টাকা ২৯ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ শতাংশ বেশি। আইএফআইসি তৃতীয় প্রান্তিকে ২২ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের তুলনায় ৪৫ শতাংশ কম। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ৭৬ পয়সা যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪২ শতাংশ কম।

যমুনা ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ১ টাকা ১১ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের তুলনায় ৮ শতাংশ কম। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ৩ টাকা ১৮ পয়সা যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ২১ পয়সা মুনাফা করেছে যা আগের তুলনায় ৫৩ শতাংশ কম। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ১ টাকা ৬৮ পয়সা যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ শতাংশ বেশি।

ন্যাশনাল ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ১০ পয়সা মুনাফা করেছে যা আগের তুলনায় ৬৩ শতাংশ কম। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ৪৭ পয়সা যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৮ শতাংশ কম।ন্যাশনাল ক্রেডিট এন্ড কমার্স ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ৬০ পয়সা মুনাফা করেছে যা আগের তুলনায় ২৬ শতাংশ কম। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ১ টাকা ৭৭ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ শতাংশ কম।

ন্যাশনাল ক্রেডিট এন্ড কমার্স ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ১৩ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের তুলনায় ৭ শতাংশ কম। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ৫০ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। স্টান্ডার্ড ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে ৬ পয়সা মুনাফা করেছে, যা আগের তুলনায় ৮৩ শতাংশ কম। নয় মাসে মুনাফা হয়েছে ১১ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৪ শতাংশ কম।

এমটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার বিষয়ে ছাড় দিয়েছে। “প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি কম রাখতে হওয়ায় ব্যাংকগুলোর খরচ কম দেখাতে হচ্ছে, তাই মুনাফা বেড়েছে।”

নিরাপত্তা সঞ্চিতি কম দেখিয়ে সুযোগ নিয়ে বেশ কিছু ব্যাংক মুনাফা বাড়িয়ে দেখাচ্ছে বলে অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর মনে করেন। তিনি বলেন, এতে ব্যাংকগুলো সামনে সমস্যায় পড়তে পারে। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে যে সব ঋণ দেওয়া হচ্ছে সেগুলোলোর মধ্যে অনেক টাকা নাও ফেরত আসতে পারে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, “করোনাভাইরাসের মন্দ অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার বিষয়ে ছাড় দিয়েছিল।

“তবে এই ছাড় এবছরের ডিসেম্বর মাসের পরে আর বাড়ানো ঠিক হবে না। কারণ এ ধরনের ছাড়ে ব্যাংকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ব্যাংকের ঝুঁকি বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলো পরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে; আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে বেশি চার্জ দিতে হতে পারে হয়।”