দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: সরকারের ইস্যু করা বন্ড বা ঋণপত্রে ব্যক্তি বিনিয়োগের সুযোগ সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। অথচ বন্ডে বিনিয়োগ হতে পারে ব্যাংক আমানত এবং শেয়ার কেনার ভালো বিকল্প। এ বাস্তবতায় ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ব্যক্তি বিনিয়োগে নতুন করে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। বন্ডের সেকেন্ডারি বাজারে লেনদেনে ব্রোকারেজ চার্জ কমানো হচ্ছে। প্রত্যেক ব্যাংকে বন্ডে বিনিয়োগের জন্য উইন্ডো স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দৈনিক লেনদেনের দর ঘোষণা এবং বিনিয়োগ আকর্ষণে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রচারসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এদিকে করোনার কারণে থমকে আছে নতুন বিনিয়োগ, যার প্রভাবে ব্যাংকের বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি আটকে আছে ৯ শতাংশের ঘরে। তবে চলতি বছরের চার মাস প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশেরও নিচে। ফলে নিরাপদে মুনাফা পেতে বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী মহামারির কারণে অর্থনীতি নিম্নগামী হলেও বেড়েই চলেছে বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, মানুষের হাতে টাকা থাকলে তাকে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ট্রেজারি বিল ও বন্ড একটি ভালো উপায়। ব্যাংকগুলো এখানে বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন এবং তারল্য সংরক্ষণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাধ্যবাধকতার কারণে। তবে ব্যক্তি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে ভালো মুনাফার পাশাপাশি যে কোনো সময় ভাঙানোর সুযোগ রাখতে হবে। শেয়ারের মতো সেকেন্ডারি বাজারে বন্ডের লেনদেনের ব্যবস্থা করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে বিল ও বন্ডে ৮০ হাজার ২৩৮ কোটি ৩২ লাখ টাকার বিনিয়োগ বেড়েছে ব্যাংকের। বিল ও বন্ডে ২০২০ সালের জুন শেষে দুই লাখ ৭৯ হাজার ৬০১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে ব্যাংক। আগের বছরের একই সময়ে এই বিনিয়োগ ছিল এক লাখ ৯৯ হাজার ৩৬৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। করোনা পরিস্থিতিতে বিল ও বন্ডের সুদহার দুই থেকে এক-চতুর্থাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। তারপরেও কমছে না বিনিয়োগ।

তথ্যমতে, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বন্ড ও বিলে তিন লাখ দুই হাজার ৭৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ব্যাংক। এর মধ্যে দুই লাখ ৪২ হাজার ২১৮ কোটি টাকার বন্ড ও ৫৯ হাজার ৮৬০ কোটি টাকার বিল বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, সুদহার কমলেও বাড়ছে বন্ডের বিনিয়োগ। করোনার মধ্যে অন্যান্য খাতের ঋণের তুলনায় এখানে বিনিয়োগে ব্যাংকগুলোর আগ্রহ তুলনামূলকভাবে বেশি। বিনিয়োগ করে কেউই ঝুঁকি বাড়াতে চায় না। ঝুকিমুক্তভাবে স্বল্প লাভেই খুশি সবাই।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংক খাতে আগস্টের শেষে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। গত দুই মাসে এ অলস অর্থের পরিমাণ আরও বেড়েছে। আগে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত তারল্যের অর্থ বিনিয়োগ করত সরকারি বিল বন্ড বা কলমানি বাজারে। কিন্তু বর্তমানে সরকারি বিল-বন্ডের সুদহার নেমে এসেছে প্রায় তিন শতাংশে। চাহিদা না থাকায় কলমানি বাজারের সুদহারও নেমেছে এক শতাংশে। তার পরও ব্যাংকগুলো ভরসা করছে বিল ও বন্ডে। কারণ নির্ধারিত সময় শেষে ঠিকই মুনাফা পেয়ে যাবে ব্যাংক।

ঋণের সুদ ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেওয়ায় আমানতের সুদও ছয় শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। নিশ্চিত মুনাফা ও নিরাপদে টাকা ফেরতের আশায় এরপরও কিছু ব্যাংকে আমানতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কারণ মানুষের হাতে টাকা রাখার জন্য ভালো বিকল্প নেই। এদিকে এত টাকা বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ কোনো খাত না থাকায় বিল ও বন্ডেই ভরসা করছে ব্যাংকগুলো।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৯১, ১৮২ ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে দেশের ব্যাংক খাত থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয় সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, করোনা পরিস্থিতি সরকারি এসব বিলের সুদহার নামিয়ে এনেছে এক-চতুর্থাংশে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল সাত দশমিক ১২ শতাংশ। অক্টোবরে তা নেমেছে এক দশমিক ৫৪ শতাংশে। জানুয়ারিতে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল সাত দশমিক ৭৯ শতাংশ, যা অক্টোবরে এক দশমিক ৭৭ শতাংশে নেমে আসে। এদিকে জানুয়ারিতে ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল সাত দশমিক ৯৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তা নেমে আসে তিন দশমিক ৮৬ শতাংশে।

ট্রেজারি বিলের মতোই সুদহার কমেছে বন্ডেরও। জানুয়ারিতে দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের গড় সুদহার ছিল আট দশমিক ২২ শতাংশ। অথচ অক্টোবরে তা তিন দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। একইভাবে ইল্ড বা সুদহার কমেছে ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডেরও। ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত তারল্য বিনিয়োগের অন্যতম বাজার কলমানিতেও সুদহার এক শতাংশে নেমেছে। অথচ ফেব্রুয়ারিতে কলমানি বাজারে গড় সুদহার ছিল পাঁচ শতাংশেরও বেশি।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, সরকারি প্রণোদনা ছাড়া অন্য কোনো খাতে ঋণ বিতরণ হচ্ছে না। বেসরকারি খাতের ঋণ বিতরণে কোনো অগ্রগতি নেই। তাই বোশিরভাগ ব্যাংকই এখন বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে। এমনকি আমাদের ব্যাংকও। কারণ নির্ধারিত মেয়াদ শেষে এর মুনাফা পেতে কোনো সমস্যা হয় না। সুদহার কম হলেও কোনো ঝামেলা ছাড়াই এই খাতে বিনিয়োগা করা যায়। কিন্তু ঋণ বিতরণ করলে গ্রাহকের অবস্থা, ব্যবসা পরিচালনার অভিজ্ঞতা এবং জামানতসহ টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা নির্ণয় করতে হয়। তার পরও সন্দেহ থাকে। করোনার মধ্যে অল্প হলেও বন্ডের নিরাপদ মুনাফা অনেক ভালো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বেশ আগে থেকেই বন্ডে ব্যক্তি বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। তবে অধিকাংশই না জানার কারণে বিনিয়োগ করেন না। এখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর অনেকেই খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।

প্রসঙ্গত, সরকারের ইস্যু করা বিল ও বন্ডকে ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ড বলা হয়। কোনো বিনিয়োগকারী যে কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘সিকিউরিটিজ অ্যাকাউন্ট’ খুলে এক লাখ টাকা বা তার গুণিতক যে কোনো অঙ্ক বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারেন এবং সেকেন্ডারি লেনদেন করতে পারেন। নির্দিষ্ট সময় অন্তর বাংলাদেশ ব্যাংকে নিলাম হয়। এটি প্রাথমিক বাজার। ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় প্রাথমিক বা সেকেন্ডারি বাজার থেকে বিল বা বন্ড কিনতে পারেন।