দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা:  ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে এবার ব্যাপক আলোচনায় এলেও গত তিন বছর ধরে কমছে চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানি; অথচ সরকারের পক্ষ থেকে একে সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবেই দেখা হচ্ছিল। আদালতের নির্দেশে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সাভারে চামড়া শিল্প নগরীতে সরিয়ে নেওয়ার পর থেকে নানা অব্যবস্থাপনা নিয়ে দোষারোপ চলছে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও কারখানা মালিকদের। ফলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চামড়া খাতের কোম্পানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সমাপ্ত অর্থবছরে সমতা লেদার নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করছে। ফলে এ খাতের প্রতি আস্থা কমছে বিনিয়োগকারীদের।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিং বা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “এই পরিস্থিতির জন্য ব্যবসায়ীদের দায় যেমন রয়েছে, তেমনি সরকারি নীতি-নির্ধারকদেরও আন্তরিকতার অভাব দেখা গেছে। এর সামগ্রিক প্রভাবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই খাত নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে।” সমস্যার সমাধানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সরকারি সংস্থাকেই অগ্রণী ভূমিকা পালনের পরামর্শ দেন তিনি।

২০১৭ সালে আদালতের নির্দেশে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলোকে স্থানান্তর করা হয় সাভারের হেমায়েতপুরে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) গড়ে তোলা চামড়া শিল্প নগরীতে। ১৫৪টি কারখানাকে এই শিল্প নগরীতে জমি বরাদ্দ দেওয়া হলেও তিন বছরেও কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি সবাই। যারা উৎপাদন শুরু করেছেন, তারাও অবকাঠামোগত নানা সমস্যার কথা বলে আসছেন।

এদিকে সরকার, ব্যবসায়ী এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) ত্রিমুখী দোষারোপে বেহাল দশায় পড়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিমুখী চামড়াশিল্প। ত্রিমুখী এই জটিলতায় ১৭ বছরেও শেষ হয়নি সাভারের ট্যানারি পল্লী খ্যাত ঢাকা চামড়া শিল্পনগরীর কাজ। দীর্ঘ আট বছরেও কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) সফলতার মুখ দেখেনি।

তিন বছরে ১৬ শতাংশের বেশি বৈদেশিক আয় কমেছে এ খাত থেকে। অথচ তিন বছর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরকে চামড়া বর্ষ ঘোষণা করেছিল সরকার। লক্ষ্য ছিল ২০২১ সালে এই শিল্প থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আয় হবে। তবে সেখানে কাজ করা বিভিন্ন পক্ষের পাল্টাপাল্টি দোষারোপে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন থেকে অনেক দূরে থাকতে হচ্ছে খাতটিকে। পাশাপাশি দিন দিন ওই এলাকার পরিবেশগত হুমকি বাড়ছে।

শিল্প মালিকরা বলেছেন, পরিবেশ রক্ষার নামে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিশিল্প সাভারে সরিয়ে নেওয়া হলেও বাস্তবে সেখানে আরও বেশি পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। চীনা ঠিকাদার ও বিসিকের গাফিলতিতে দীর্ঘ আট বছরেও কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) সফলতার মুখ দেখেনি। ভবিষ্যতে এটি আলোর মুখ দেখবে বলে আশা করছেন না তারা। এতে বিদেশি ক্রেতাদের জোট লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) বাংলাদেশমুখী হচ্ছে না। অন্যদিকে সরকারি সংস্থা বিসিক বলছে, কিছু ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকলেও ট্যানারি মালিকদের অসহযোগিতার কারণে সিইটিপি পুরোপুরি সফল হতে পারছে না।

ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ। যিনি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে নিবিড়ভাবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তার মতে, হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরী এখনো সফল না হওয়ার পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ দায়ী।

প্রথমত, শিল্প মালিকদের গা ছাড়া ভাব। তারা শুরু থেকে নানা ধরনের অভিযোগ তুলতে থাকেন। এর মধ্যে রয়েছে, সিইটিপির নির্মাণ শেষ না হওয়া, কঠিন বর্জ্যরে খোলামেলা ডাম্পিং, জমির দাম ঠিক না করা, প্লটের ইজারা দলিল বুঝে না পাওয়াসহ ইত্যাদি।

দ্বিতীয়ত, শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিসিকের হাতে শিল্প নগরী উন্নয়নের দায়িত্ব দেওয়া। অনভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার অভাবে প্রতিষ্ঠানটি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি। তৃতীয় সমস্যা হয়েছে সিইটিপি নির্মাণে ঠিকাদার বাছাই।

২০১২ সালে সিইটিপি নির্মাণে দায়িত্ব দেওয়া হয় চীনের একটি প্রতিষ্ঠানকে। তবে প্রতিষ্ঠানটির এ বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না বলে অভিযোগ আছে। অবশ্য বিসিক এ প্রকল্প নির্মাণে নিজেদের অনভিজ্ঞতার কথা স্বীকারও করেছে। ট্যানারি শিল্প নগরীর প্রকল্প পরিচালক জিতেন্দ্র নাথ পাল বলেন, আমরা স্বীকার করি এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে বিসিকের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে সমস্যা কিছুটা হয়েছে।

ট্যানারি মালিক, বিসিক ও শ্রমিক নেতারা জানান, কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বা সিইটিপি নির্মাণের জন্য সরকার হাজারীবাগে ট্যানারিশিল্পের প্রতিদিন উৎপাদিত বর্জ্য পানির ওপর সমীক্ষা চালায়। সে অনুযায়ী ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫ হাজার ঘনমিটার পানি ধারণক্ষমতার সিইটিপি নির্মাণের কাজ প্রায় শেষের দিকে। তবে হেমায়েতপুরের কারখানাগুলো দৈনিক ৪০-৪৫ হাজার ঘনলিটার বর্জ্য পানি ছাড়ছে। ফলে ধারণক্ষমতা না থাকায় পানি ড্রেন উপচে সড়কে চলে যায়। অনেক কারখানা সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে ফেলে দেয়।

এ ছাড়া ট্যানারির কঠিন বর্জ্য পরিশোধনের জন্য সিইটিপিতে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে চামড়াশিল্প নগরীর দক্ষিণ পাশে খোলা আকাশের নিচে ফেলা হচ্ছে। এতে চরম দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়ে স্থানীয় জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আবুল কালাম আজাদ বলেন, এটা কমপ্লিটলি ভুল হয়েছে। পরিবেশবান্ধব সিইটিপি করতে হলে সলিড ওয়েস্ট (কঠিন বর্জ্য) ম্যানেজমেন্ট ও লিকুইড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট দুটোই থাকতে হবে। অথচ এর মধ্যে একটা আছে আরেকটা নেই। যে একটা আছে, সেটাও কমপ্লিট কাজে আসছে না।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ২০১৭ সাল থেকে বিসিক বলে আসছে তাদের সিইটিপি রেডি অথচ ২০২০ সালের শেষে এসে দেখা যাচ্ছে এটি কাজে আসছে না। বিসিকের অদক্ষতা দুর্নীতি, বুয়েটের সমীক্ষার ভুল, চায়নিজ প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা আমাদের ডোবাচ্ছে।
সিইটিপি নির্মাণে চীনা ঠিকাদারের গাফিলতির কথা স্বীকার করেছেন প্রকল্প পরিচালক জিতেন্দ্র নাথ পাল। তবে সিইটিপি পুরোপুরি সফল না হওয়ার পেছনে ট্যানারি মালিকদের দোষারোপ করেছেন তিনি।

জিতেন্দ্র নাথ পাল বলেন, হাজারীবাগের অ্যাসেসমেন্ট ধরে সিইটিপি করায় এ সমস্যা হয়েছে ঠিকই, তবে সব কারখানাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করছে। হাইকোর্টের নির্দেশে কারখানাগুলোর পাইপলাইনে তিন ধরনের ছাঁকনি বা জালি থাকার কথা। কিন্তু একটি কারখানাও সেটি লাগায়নি। তারা চামড়ার টুকরা মিশ্রিত পানি সিইটিপিতে ছেড়ে দেয়।

কঠিন বর্জ্য খোলা আকাশের নিচে ফেলার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা কোনো পদ্ধতি হয়নি। তবে আমরা দুটি ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণ করছি। এটা আপাতত সমাধান হতে পারে। তবে এর স্থায়ী সমাধানের জন্য দরকার বর্জ্য রিসাক্লিং প্রকল্প। চেষ্টা চলছে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানিয়ে এসব বর্জ্য পুনরায় ব্যবহার করার।

রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীদূষণ ও হাজারীবাগ-কামরাঙ্গীরচর এলাকার পরিবেশ রক্ষায় ২০০৩ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারি শিল্পনগরী সরিয়ে নেওয়ার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এ জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ২০০ একর জায়গা। শিল্পনগরী উন্নয়নে দায়িত্ব পায় সরকারি সংস্থা বিসিক। শুরু থেকে ট্যানারি মালিকদের মধ্যে এ প্রকল্প নিয়ে গা ছাড়া ভাব ছিল। ২০১৭ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশে হাজারীবাগে ট্যানারি কারখানার গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেওয়া হলে মালিকরা হেমায়েতপুরে যেতে বাধ্য হন।

এদিকে ট্যানারি পল্লীর এই জটিলতার কারণে ধস নেমেছে এই খাতের রপ্তানি আয়েও। রুপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রায় ১৬ শতাংশ বাজার পতন হয়েছে। এ বছর বাংলাদেশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ১০২ কোটি ডলার আয় করে, যা আগের বছরের চেয়ে ৬ শতাংশ কম।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া খাতে রপ্তানি আয় ছিল ১২৩ কোটি ডলারের বেশি। ২০১৩-১৪ সাল থেকে এ খাতের আয় ১ দশমিক শূন্য ৮ থেকে ১ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করেছে। অন্যদিকে, ভারতের ৩ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের বিপরীতে চীনের আয় ১০ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান করছে ৯৪৮ মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা।

বিটিএ সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, চলতি বছরের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ৯০ মিলিয়ন ডলার চামড়া ও চামরাজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তিন বছর আগে এ সময় এটা ছিল ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। সিইটিপি না হওয়ার কারণে ইউরোপের ক্রেতাদের জোট এডব্লিউজি আমাদের দেশে আসছে না। এ জন্য আমরা বড় ক্ষতির মুখে পড়ছি।

ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক বলেন, এলডব্লিউজির সনদ পেতে হলে মালিকদেরও সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স করতে হবে। শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, স্থায়ীকরণ, বেতন-ভাতা, গ্রাচ্যুইটি ইত্যাদি ঠিকঠাক দিতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মালিকরা এসব বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছেন।
উল্লিখিত সমস্যাগুলোর পাশাপাশি সেখানকার সমন্বয়হীনতার কারণে পরিবেশগত হুমকিও দেখা দিয়েছে ওই এলাকার, ধলেশ্বরীসহ সংশ্লিষ্ট নদ-নদীর। ট্যানারি শিল্পনগরীর চিত্র দেখতে ১৯ নভেম্বর হেমায়েতপুরে যান এই প্রতিবেদক।

শিল্পনগরীর দক্ষিণ দিকের সীমানাপ্রাচীরসংলগ্ন সিইটিপি। তার পাশে দেয়াল ঘেঁষে উন্মুক্ত স্থানে চামড়ার কঠিন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। বর্জ্যরে দুর্গন্ধ এতটাই বিকট যে আশপাশ দিয়ে চলাচল কঠিন। নির্ধারিত স্থান ছাপিয়ে ট্যানারির মূল রাস্তার দুপাশেও পাহাড়ের স্তূপ গড়ে উঠেছে। বর্ষার সময় বৃষ্টিতে ধুয়ে ট্যানারির সেই কঠিন বর্জ্য নদীতে পড়ে।

শ্রমিকরা জানান, আশপাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন পোলট্রি ফিড কারখানায় এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে ধলেশ্বরী নদীর বুক চিরে বের হচ্ছে তরল সেই দূষিত বর্জ্য। আগে সরাসরি ফেলা হলেও এখন নদীর তলদেশ দিয়ে পাইপ দিয়ে বর্জ্য পাঠিয়ে ফেলা হচ্ছে মাঝ নদীতে। এতে নদীতে মাছ মরে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

বর্জ্য যেখানে ফেলা হচ্ছে, সেই দেয়ালের ওপারেই জমজম সিটি এলাকা। সেখানকার বাসিন্দা রাতুল আহমেদ বলেন, এখানে মানুষ বসবাসের আর কোনো সুযোগ নেই। আমরা বাড়িভিটে ছাইড়্যা যাব কোথায়? দুর্গন্ধে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে দেয়াল ভেদ করে পানি এসে এলাকা সয়লাব হয়ে যায়। এসব প্রতিবাদ করলে পুলিশ দিয়ে আমাদের হয়রানি করা হয়।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিসিক) কাজী সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ট্যানারিশিল্পের সমস্যাটা দীর্ঘদিনের। সমস্যা সমাধানে মালিকপক্ষের অসহযোগিতা একটা বড় বাধা। আমরা দফায় দফায় তাদের সঙ্গে বৈঠক করছি। সবাই এগিয়ে এলে নিশ্চয় সমাধান হবে।