দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের শেয়াবাজারের সূচক বেড়েছে ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা ব্লুমবর্গের জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে দেখা যায়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের শেয়ারবাজারের প্রধান সূচক এসএন্ডপি বিএসই বেড়েছে ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। পাকিস্তানের শেয়ারবাজারের প্রধান সূচক কেএসই অল শেয়ার এর ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ, ভিয়েতনামের প্রধান শেয়ারবাজার হো চি মিনাহ স্টক ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ,

শ্রীলঙ্কার সিএসই অল শেয়ার এর সূচক বেড়েছে ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা স্টক এক্সচেঞ্জ কম্পোজিট এর সূচক কমেছে ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ, মালয়েশিয়ার প্রধান সূচক এফটিএসই বুরসা মালয়েশিয়া কেএলসিআই ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ, থাইল্যান্ডের প্রধান সূচক সেট কমেছে ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ, ফিলিপাইনের প্রধান সূচক ফিলিপাইনস স্টক এক্সচেঞ্জ পিএসইআই কমেছে ৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

দেখা যায়, গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনা মহামারির প্রকোপ বৃদ্ধির পর সারাদেশ লকডাউন করা হয়। ওই সময় দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ৬৬ দিন বন্ধ রাখা হয়। যার ফলে সূচকে ব্যাপক ধস নামে। কিন্তু শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বে নতুন কমিশন বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়িয়ে বাজারকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফেরাতে সক্ষম হয়েছেন।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শেয়ারবাজার নির্ভর করে বিনিয়োগকারীদের ওপর। তাদের আস্থার ওপর বাজারের স্থিতিশীলতা নির্ভরশীল। নতুন করে পুনঃগঠিত বিএসইসির বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনেকটা আস্থা ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। যার ফলে গত ২৭ ডিসেম্বর বড় উত্থানে ডিএসইর বাজার মূলধন ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৩৯৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে; যা ডিএসইর ইতিহাসে পঞ্চম সর্বোচ্চ।

এর আগে ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি সর্বোচ্চ বাজার মূলধন ছিল। ওইদিন ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ২৮ হাজার ৫০৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছাড়িয়েছে ৫ হাজার ৩শ’ পয়েন্ট।

অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বে নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যবসা সম্প্রসারণে পুঁজি সংগ্রহের জন্য রবিসহ প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) অনুমোদন পেয়েছে ১৫টি, রাইট অনুমোদন পেয়েছে ২টি এবং বন্ডের মাধ্যমে টাকা তোলার অনুমোদন পেয়েছে ১৮টি প্রতিষ্ঠান। এসব কোম্পানির শেয়ারবাজার থেকে ৯ হাজার ২৭১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করে শিল্পায়নে বিনিয়োগ হচ্ছে। এই টাকা দেশের শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থানের উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করবে কোম্পানিগুলো।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে দেশের শেয়ারবাজার পুঁজিবাজার। শেয়ারবাজার দেশের শিল্পায়নের অক্সিজেন হিসেবে কাজ করে। বিনিয়োগকারীদের অংশীদারিত্ব দেওয়ার মাধ্যমে বাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে। এর মাধ্যমে কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণ করে। ফলে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় প্রতিষ্ঠানের।

কোম্পানি বড় হলে তৈরি হয় নতুন কর্মসংস্থান। যার সামগ্রীক প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতে। গতবছরজুড়ে ধারাবাহিকভাবে সূচকের পতনে সাধারণ বিনিয়োগকারী যখন দিশেহারা, ঠিক তখনই শুরু হয় করোনা মহামারি। ২৬ মার্চ বন্ধ হয়ে যায় পুঁজিবাজার। ৬৬ দিন পর গত ৩১ মে ফের পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু হয়। ওই দিন লেনদেন শুরুর পর থেকে গত ৬ মাসে পর্যন্ত মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বেড়েছে সূচক ও লেনদেন।

এ সময়ে ডিএসইএক্স সূচক বেড়েছে ১৩০০ পয়েন্টের বেশি। ৩১ মে ডিএসই’র প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৪০৬০ পয়েন্টে। ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩২৮৬ পয়েন্টে। একইভাবে গত ৬ মাসে ডিএসই’র লেনদেন বেড়েছে ৮০০-৯০০ কোটি টাকার বেশি। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধনও বেড়েছে অনেক।

মে মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন কমিশন সুশাসন ফেরাতে আইন সংস্কার ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেয়। দুর্বল ও লোকসানে থাকা কোম্পানিতে স্বচ্ছতা আনতে প্রশাসক বসানো এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ পরিবর্তনেরও নির্দেশনা জারি করা হয়। এছাড়াও তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ন্যূনতম ২ শতাংশ এবং সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা হয়।

এ বিষয়ে বিএসইসি’র চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও সুশাসন ফেরানোর ওপর জোর দেওয়া হয়। বিনিয়োগকারীর স্বার্থকে প্রাধ্যান্য দিয়ে পুঁজিবাজারের আইন-কানুন প্রণয়ন করা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীর জমানো মূলধন কেউ যেন খেয়ে ফেলতে না পারে, সে বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বড় বড় দুষ্ট শক্তি যদি শেয়ারবাজারে এসে খেলতে চায়, সেটা তারা আর পারবে না। আমরা বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা দিব।

বিএসইসি’র তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৫টি কোম্পানির মধ্যে সব চেয়ে বেশি পুঁজি সংগ্র করছে রবি আজিয়াটা। কোম্পানিটি শেয়ারবাজার থেকে ৫২৩ কোটি ৭৯ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪০ টাকা উত্তোলন করবে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এনার্জিপেক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড এবং লুব-রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেড। কোম্পানি দুটি শেয়ারবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে ১৫০ কোটি টাকা করে উত্তোলন করবে। আইপিওর মাধ্যমে অর্থ উত্তলনের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে মীর আক্তার হোসাইন লিমিটেড।

কোম্পানিটি বাজার থেকে ১২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করবে। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে দেশের চতুর্থ প্রজন্মের ব্রাংক এনআরবিসি কমার্শিয়ার ব্যাংক লিমিটেড। কোম্পানিটি শেয়ারবাজার থেকে ১২০ কোটি টাকা উত্তোলন করার জন্য অনুমোদন পেয়েছে। পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে দেশের ইলেক্ট্রকিন পণ্য উৎপাদনে জায়ান্ট কোম্পানি ওয়াল্টন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। কোম্পানিটি বাজার থেকে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করার জন্য অনুমোদন পেয়েছে।

এছাড়াও ইনডেক্স এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৫০ কোটি টাকা, এসোসিয়েট অক্সিজেন ১৫ কোটি টাকা,এএফসি হেলথ্ ১৭ কোটি টাকা,ডমিনেজ স্টিল বিল্ডিং সিস্টেম ৩০ কোটি টাকা,ক্রিস্টাল ইন্সুরেন্স ১৬ কোটি টাকা এবং তৌফিকা ফুডস এন্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৩০ কোটি টাকা, সোঁনালী লাইফ ইন্সুরেন্স ১৯ কোটি টাকা, দেশ জেনারেল ইন্সুরেন্স ১৬ কোটি টাকা শেয়ারবাজার থেকে উত্তোলন করার অনুমোদন পেয়েছে।

দুটি কোম্পানিকে অগ্রাধিকামূলক শেয়ারের (রাইট) মাধ্যমে ৭৭ কোটি ৭৬ লাখ ৫০ হাজার ৭৭৫ টাকা তুলার অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। এছাড়াও নতুন কমিশন ১৮টি কোম্পানি বন্ড ইস্যু করেছে। এর মাধ্যমে কোম্পানিগুলো ৭ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা তুলেছে।