আবদুর রাজ্জাক ও এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বিশ্বব্যাপী করোনার থাবা বাংলাদেশেও পড়েছে। তবে সরকারিভাবে পূর্ব প্রস্তুতি থাকায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে প্রভাব কিছুটা কম পড়লেও অসংখ্য চাকরিজীবী চাকরি হারিয়েছেন। অনেক উদ্যোক্তা থমকে গেছেন। করোনা ইস্যুতে মধ্যম ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। একই সঙ্গে বিকল্প হিসেবে সব ধরনের বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। যার প্রভাব রীতিমতো পুঁজিবাজারে পড়েছে।

্এদিকে দেশের বৃহৎ পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স সূচকটি বছরের প্রথম কার্যদিবস ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উত্থান হয়েছে। এদিন ডিএসইএক্স বেড়েছে ২১৭ পয়েন্ট। যা সূচকটি চালু হওয়ার ৮ বছরের মধ্যে একদিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উত্থান। এদিন ডিএসইতে টাকার পরিমাণে লেনদেনেও বড় উত্থান হয়েছে।

ডিএসইতে ডিএসইএক্স সূচকটি ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ৪০৫৬ পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এরপরে বিগত ৮ বছরের মধ্যে সূচকটি আজ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উত্থান হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি ইতিহাসের সর্বোচ্চ অর্থাৎ ২৩২ পয়েন্ট উত্থান হয়েছিল। এরও আগে চলতি বছরের ৯ আগস্ট তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৮০ পয়েন্ট,

১৬ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ সর্বোচ্চ ১৬৯ পয়েন্ট, ১৬ আগস্ট পঞ্চম সর্বোচ্চ ১৫৬ পয়েন্ট এবং ২০১৫ সালের ১০ মে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ ১৫৫ পয়েন্ট বেড়েছিল। এদিকে আজ ডিএসইর ডিএসইএক্স সূচকটি ১ বছর ৯ মাস ১৪ দিন বা ৩৯২ কার্যদিবস পর ৫ হাজার ৬০০ পয়েন্ট অতিক্রম করেছে। এর আগে ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ সূচকটি আজকের চেয়ে বেশি অবস্থানে ছিল। ওই দিন ডিএসইক্স সূচকটি ৫ হাজার ৬৩১ পয়েন্টে অবস্থান করছিল।

জানা গেছে, বিনিয়োগকারীদের হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বছরটি শুরুই হয়েছিল। সূচক কমছিল ধারাবাহিকভাবে। শেয়ারের দাম নেমেছিল তলানিতে। এক কাপ চায়ের দামের চেয়েও সস্তায় পাওয়া যেত অনেক কোম্পানির শেয়ার। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব বিনিয়োগকারীদের নামতে হয় রাস্তায়। পতন ঠেকাতে বেঁধে দেওয়া হলো শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোরপ্রাইস।

এরপর করোনার হানায় ৬৬ দিন লেনদেন বন্ধ। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় সরকার ও পুনর্গঠিত কমিশন। তাতে বছরের শেষ ভাগে এসে চাঙ্গা পুঁজিবাজার। করোনার বছরটি দুশ্চিন্তা ও দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শুরু করেছিলেন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা, শেষটা ছিল ফুরফুরে মেজাজের।

শুধু তাই নয়, করোনার সংকটকালে অর্থনীতির যে কয়েকটি খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তার মধ্যে পুঁজিবাজার অন্যতম। ২০২০ সালের শুরুতে পুঁজিবাজার ছিল হতাশার, সেটি এখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। শুধু তাই নয়, মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপে সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও ২০২০ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করেছেন উদ্যোক্তারা।

বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২১ সালের বাজার একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজারে পরিণত হতে যাচ্ছে। কারন ব্যাংকের শেয়ার ছাড়াই দুইশ পয়েন্টের বেশি সূচক বৃদ্ধি বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থার প্রমাণ হিসেবে দেখছেন। অতি সম্প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি সিদ্ধান্ত নেয়, সেকেন্ডারি মার্কেটে ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে আইপিও আবেদন করলেই আনুপাতিকহারে বন্টন হবে শেয়ার। এটিও লেনদেন বাড়ার একটি কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। শুধু আইপিওর জন্য ব্যবহৃত বিও হিসাবগুলো সচল করতে নতুন বিনিয়োগ করছেন বিনিয়োগকারীরা।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, ‘বিনিয়োগ করে মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে, এতে শুধু খুশি হলেই চলবে না। কারণ পুঁজিবাজার ভালো হলেই কারসাজিকারীরা তাদের নেতিবাচক কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমান কমিশন এ ব্যাপারে সচেতন আছে। তবে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আরো সজাগ থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সবাই শেয়ার পাবে এই উদ্যোগের কারণে বিনিয়োগকারীরা লেনদেন না হওয়া বিও হিসাবগুলোকে সচল করতে নতুন বিনিয়োগ করছে। বিনিয়োগকারীদের ধারণা প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) শেয়ার পেলে তাতে লাভ বেশি পাওয়া যায়।’

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা যেভাবে আগ্রহ দেখিয়েছেন, তাতে ২০২১ সালে দেশের শেয়ারবাজার একটি শক্তিশালী বাজারে পরিণত হতে পারে। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি যতদিন উন্নতি না হবে, ততদিন মানুষ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করবে। এছাড়া বর্তমান কমিশন এই বাজারের উন্নয়নে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তার একটা সুফল পাওয়া যাবে।

বাজারের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, আগের বছরের তুলনায় এ বছর আইপিও’র মাধ্যমে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তিনগুণের বেশি অর্থ নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। এমনকি গত তিন বছরে সম্মিলিতভাবে যে পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে, শুধু ২০২০ সালেই তার থেকে বেশি অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। অবশ্য আইপিও’র মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হলেও বছরের শুরুর চিত্র মোটেও ভালো ছিল না। মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ফলে এ সময় বন্ধ থাকে শেয়ারবাজারের লেনদেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থায় সঠিক ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে এই বাজার করোনাকালেও ভালো পারফরম্যান্স করেছে। ২০২১ সালের পুঁজিবাজার আরো ভালো পারফরম্যান্স করবে বলে তিনি মনে করেন।
এর আগে ২০১৯ সালে একের পর এক দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তবে গত বছরের মে মাসের শেষদিকে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেওয়ার পর আইপিও মার্কেট সরগরম হয়ে ওঠে। তার নেতৃত্বাধীন কমিশন একের পর এক প্রতিষ্ঠানের আইপিও দিতে থাকে। ফলে মাত্র সাত মাসেই রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলনের সুযোগ পেয়ে যান উদ্যোক্তারা।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২০ সালে স্থির মূল্য (ফিক্সড প্রাইস) পদ্ধতিতে পাঁচটি এবং বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে তিনটি কোম্পানি আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করেছে। সম্মিলিতভাবে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্তোলন করা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭০৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রিমিয়াম বাবদ তিনটি কোম্পানি নিয়েছে এক হাজার ৩৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে স্থির মূল্য (ফিক্সড প্রাইস) পদ্ধতিতে পাঁচটি এবং বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে তিনটি কোম্পানি অর্থাৎ আটটি প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে আইপিও’র মাধ্যমে ৫৫২ কোটি টাকা সংগ্রহ করে।

২০১৮ সালে ১৪টি প্রতিষ্ঠান ৬০১ কোটি ৭৫ লাখ, ২০১৭ সালে আটটি প্রতিষ্ঠান ২৪৯ কোটি ২৫ লাখ এবং ২০১৬ সালে ১১টি প্রতিষ্ঠান ৮৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা উত্তোলন করে। এই হিসাবে ২০২০ সালে আইপিও’র মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন হলেও আইপিওতে আসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়েনি।২০২০ সালে আইপিওতে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন এবং রবি আজিয়াটা লিমিটেড ও মীর আখতার হোসেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, ২০২০ সালের শেষ ছয় মাসে শেয়ার বাজারে যেভাবে উত্তরণ হয়েছে, এতে নিশ্চিত করে বলা যায় ২০২১ সালে দেশের শেয়ারবাজার একটি শক্তিশালী বাজারে পরিণত হবে। তবে এক্ষেত্রে বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি আরো বাড়ানোর দরকার হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সম্প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা নিয়ে আর ভয় নেই। আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে এই স্থিতিশীলতা আরও জোড়ালো হবে। কারন বর্তমান কমিশন অনেক সক্রিয়। হঠাৎ করে কোনো শক্তি যেন পুঁজিবাজারকে ফেলে দিতে না পারে সেদিকে আমরা খেয়াল রাখছি। আমরা বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় কাজ করছি।