তৌফিক ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের অপেক্ষায় থাকা নকল মাস্ক সরবরাহকারী ও নিন্মমানের কোম্পানি জেএমআই হসপিটাল লিমিটেড। মুলত স্বাস্থ্য খাতে লুটপাটের পর এবার পুঁজিবাজার থেকে লুটপাট করতে চায় জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড। করোনা মহামারির দূর্যোগকালীন সময় মাস্ক কেলেঙ্কারীতে শাহেদ, সাবরিনাদের মতো বিতর্কের জন্ম দেয় জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড।

আর এই বিতর্কিত কোম্পানিটিকেই পুঁজিবাজারে আনার জন্য এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে বিএসইসি’র একটি সিন্ডিকেট চক্র। তবে এরা কারা এদের মুখোশ উন্মোচনের এখনই সময় বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। কারন ধরনের প্রতারক ও বাটপার কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিকট দাবী জানিয়েছেন বিনিয়োগকারী ও বাজার বিশ্লেষকরা। কারন এ জাতীয় কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসে লুটপাট করতে, বরং সাধারন বিনিয়োগকারীদের কিছু দিতে আসে না।

কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের থেকে ৭৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে চায়। এ জন্য রোড শো করেছে কোম্পানিটি। তবে কোম্পানিটির আইপিও আবেদন গত ৩০ জুলাই বাতিল করে দিয়েছিল কমিশন। কিন্তু সেই কমিশনই এখন কোম্পানিটিকে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যাতে করে কোম্পানিটি আইপিও প্রক্রিয়ায় অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে।

এই জেএমআই হসপিটাল থেকে জীবন রক্ষাকারী এন-৯৫ মাস্ক এর নামে নকল মাস্ক সরবরাহ করে ডাক্তার-নার্সদের ঝুকিঁ তৈরী করা হয়। পরে আবার দায়মুক্তি চেয়ে ক্ষমাও চায় প্রতিষ্ঠানটি। তবে বিনিয়োগকারীরা এ প্রতিষ্ঠানটিকে আর পুঁজিবাজারে দেখতে চান না। তাদের দাবি, যে কোম্পানির কাছে টাকাই সব, জীবনের মূল্য নেই। সে কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজন নেই। এ কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেয়া হলে বিনিয়োগকারী পরিষদের পক্ষ থেকে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবেন বলে বিনিয়োগকারী সংগঠনগুলো জানিয়েছে।

নকল মাস্ক সরবরাহের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও নজড়ে আসে। তিনি এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেন, এন-৯৫ লেখা বক্স, কিন্তু ভিতরের যে জিনিসটা, সেটা দেখা দরকার। এখানে নজড় দেন। লেখা এন-৯৫ থাকলেও ভিতরে সবসময় সঠিকটা যাচ্ছে না। কেউ যদি এরকম কিছু করে থাকে এবং তার সাপ্লায়ার কে? বাবুনগর হাসাপাতালে এমন গেছে।

ওটাতো করোনাভাইরাসের জন্য ডেডিকেটেড। এমন যদি কিছু কিছু জায়গায় হয়, সেটাতো ঠিক না। তাই যাদেরকে এইসব পণ্য সরবরাহের ব্যবসা দেওয়া হয়, সেদিকে নজড়দারি বাড়ানো দরকার। কারন বক্স ঠিক থাকলেও ভিতরে থাকছে না। তাই যিনি পণ্য গ্রহণ করবেন, তিনি যেনো দেখেশুনে নেন, আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই।

জেএমআই হসপিটাল বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে পুঁজিবাজার থেকে টাকা উত্তোলন করতে ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারে রোড শো করে। ওই টাকা দিয়ে জমি ক্রয়, ভবন তৈরী, মেশিনারীজ ক্রয়, ঋণ পরিশোধ ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করতে চায়। এই টাকা উত্তোলনের কাজে ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছে আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট এবং জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ২০ হাজার ৬০০ পিস মাস্ক এন-৯৫ হিসেবে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সিএমএসডি) সরবরাহ করেছিল জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড। দুটি চালানের মাধ্যমে এই মাস্ক সরবরাহ করেছিল। প্যাকেটের মোড়কে এন-৯৫ মাস্ক লেখা থাকলেও ভিতরে পাওয়া যায় নকল মাস্ক। যা কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিদর্শনে উঠে আসে। ফলে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের ভাণ্ডার ও রক্ষণের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এ নিয়ে জেএমআই হসপিটালকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জবাব দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

বিষয়টি স্বীকার করে জেএমআই হসপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক চিঠির জবাবে জানান, নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে সংকটময় সময়ে মাস্কের সংকট দেখা দিয়েছে। জেএমআই হসপিটাল স্বপ্রণোদিত হয়ে মাস্ক তৈরির চেষ্টা করছে, যা এখনো প্রডাক্ট ডেভেলপমেন্ট পর্যায়ে আছে। যে সময় মাস্কগুলো সরবরাহ করা হয়, তখনো দেশে এন-৯৫-এর স্পেসিফিকেশন সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন ছিল না।

সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে বেশকিছু পণ্য সরবরাহ করে। সরবরাহকৃত পণ্যের সঙ্গে ভুলক্রমে প্রডাক্ট ডেভেলপমেন্ট পর্যায়ে তৈরীকৃত ২০ হাজার ৬০০ পিস এন-৯৫ মাস্ক অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা এন-৯৫-এর স্পেসিফিকেশনের সঙ্গে ‘কমপ্লাই’ করে না।

চিঠিতে আরো বলা হয়, ‘ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও উপরোক্ত ব্যাখ্যা সদয় বিবেচনাপূর্বক সরবরাহকৃত মাস্ক ফেরত দিয়ে আমাদের অনিচ্ছাকৃত সম্পাদিত ভুলের দায় হতে মুক্তি দানে বাধিত করবেন।’

পুঁজিবাজারে আসার প্রক্রিয়ায় থাকা জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফেকচারিং লিমিটেডের বিরুদ্ধে করোনার সময় বড় ধরনের জালিয়াতি কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের তদন্তে বিষয়টি ধরা পড়ার পর অপরাধের বিষয়টি স্বীকার করে লিখিতভাবে ক্ষমা ও দায়মুক্তি চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
জেএমআই কর্তৃপক্ষ অবশ্য এটিকে অনিচ্ছাকৃত ভুল হিসেবেই দাবি করেছে।

তাদের দাবি, সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক সরবরাহ করতে গিয়ে ভুলে এন ৯৫ মাস্ক এর প্যাকেটে ভরে ফেলা হয়েছে সেগুলো। যদিও এন ৯৫ মাস্ক প্রস্তুতের অনুমোদন পাওয়ার আগেই কোম্পানিটিতে এত বিশাল পরিমাণ প্যাকেট কী উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

এছাড়া জেএমআই সিরিঞ্জ অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসেস লিমিটেড নামীয় প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়তি দামে সিরিঞ্জ কিনছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে চড়া দামে বিপুল পরিমাণ অটো ডিজঅ্যাবল (এডি) সিরিঞ্জ কিনছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে নিম্ন মানের মাস্ক ও সরবরাহের দায়ে সম্প্রতি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এ প্রতিষ্ঠানটির সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনও মামলা করে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধক টিকা দেয়ার জন্য তিন কোটি ৩০ লাখ এডি সিরিঞ্জ কিনছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ সিরিঞ্জের প্রতিটির দাম ধরা হয়েছে পাঁচ টাকা ৪০ পয়সা।

পাঁচ কিস্তিকে এ সিরিঞ্জ সরবরাহের ক্রয়াদেশ দেয়া হয়েছে জেএমআই সিরিঞ্জ অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসেসকে। প্রতি কিস্তিতে ৬৫ লাখ সিরিঞ্জ সরবরাহ দেয়ার আদেশ রয়েছে। এ সিরিঞ্জ কিনতে সরকারের ব্যয় হবে ১৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা। গত ২১ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমএনসি অ্যান্ড এএইচ শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক স্বাক্ষরিত আদেশে জেএমআই সিরিঞ্জস অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসেস লিমিটেডকে এ কার্যাদেশ দেয়া হয়।

আন্তর্জাতিক অনলাইন মার্কেটপ্লেস আলিবাবা ডটকম সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটি একই মানের সিরিঞ্জের মূল্য এক সেন্ট থেকে চার সেন্ট। এতে প্রতিটি সিরিঞ্জের দাম পড়ে ৮৫ পয়সা থেকে তিন টাকা ৪০ পয়সা পর্যন্ত। ২৫ শতাংশ মূসক ও কর যোগ করা হলে প্রতিটি সিরিঞ্জের দাম পড়ে এক টাকা ছয় পয়সা থেকে চার টাকা ২৫ পয়সা।

এতে তিন কোটি ৩০ লাখ সিরিঞ্জ কিনতে সরকারের ব্যয় হতো তিন কোটি ৩৯ লাখ ৮০ হাজার থেকে ১৪ কোটি দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা। অথচ সরকার কিনছে ১৭ কোটি ৮২ লাখ টাকায়। অর্থাৎ সরকারের গচ্ছা যাচ্ছে তিন কোটি ৭৯ লাখ ৫০ থেকে ১৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা পর্যন্ত। ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি জেএমআই সিরিঞ্জ অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসেস লিমিটেড প্রতিটি ০.৫ এমএল এডি সিরিঞ্জের ট্রেড প্রাইস নির্ধারণ করেছিল চার টাকা ৫১ পয়সা। আর এক এমএল এডি সিরিঞ্জের মূল্য চার টাকা ১৪ পয়সা এবং তিন এমএল এডি সিরিঞ্জের মূল্য ধরা হয় চার টাকা ৫১ পয়সা।

তবে সিরিঞ্জ আমদানিকারকরা জানান, জেএমআই গ্রুপ ঔষধ প্রশাসনের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমানকে ম্যানেজ করে এডি সিরিঞ্জ আমদানি বন্ধ করে দেয়। এতে ভোক্তারা বেশি দামেই জেএমআইয়ের কাছ থেকে সিরিঞ্জ কিনতে বাধ্য হন। শুধু সিরিঞ্জই নয়, জেএমআই যেসব পণ্য উৎপাদন করত তা আমদানিতে বাধা দেয়া হতো।

বাংলাদেশ মেডিকেল ইকুইপমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইনস্ট্র–মেন্ট ডিলারস অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও সিরিঞ্জ আমদানিকারক জাভেদ আহমেদ বলেন, ০.৫ মিলির একটি এডি সিরিঞ্জ চীন থেকে আমদানি করা হলে সব ধরনের খরচসহ সর্বোচ্চ দাম তিন টাকার বেশি পড়বে না। শুধু জাভেদ আহমেদই নন, একাধিক আমদানিকারকের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. খুরশিদ আলম বলেন, দেশের একমাত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জেএমআই থেকে সিরিঞ্জ কেনা হচ্ছে। তবে কেউ যদি জেএমআইয়ের চেয়ে কম দামে সিরিঞ্জ সরবরাহ করতে পারে, তাহলে পরবর্তীকালে সেখান থেকেই সিরিঞ্জ কেনা হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আরও সিরিঞ্জ প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেএমআই সিরিঞ্জ এন্ড মেডিকেল ডিভাইস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বৃহৎ করদাতা বিবেচনায় গত বছর সিআইপি নির্বাচিত হয়েছেন নোয়াখালীর এই ব্যবসায়ী।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিএমএসডির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে তার। তাদের মাধ্যমেই বড় বড় সরবরাহ আদেশ বাগিয়ে নেন তিনি। সর্বশেষ করোনাকালীন দুর্যোগময় সময়ে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গ্ল্যাবসসহ মেডিকেল সরঞ্জাম সরবরাহের কাজও পেয়েছে তার কোম্পানি।

উল্লেখ, জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট লিমিটেড হচ্ছে জেএমআই গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। কোম্পানিটি বুক বিল্ডিং পদ্ধতির আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে টাকা উত্তোলন করার প্রক্রিয়ায় আছে। এছাড়া বর্তমানে জেএমআই গ্রুপের একটি কোম্পানি জেএমআই সিরিঞ্জেস অ্যান্ড ডিভাইসেস লিমিটেড পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আছে। এই কোম্পানির বিরুদ্ধেও নানা ধরনের কারসাজির মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের প্রতারিত করার অভিযোগ আছে। সর্বশেষ গত বছরের প্রথমভাগে কোম্পানি বড় ধরনের তথ্য জালিয়াতি করেছে বলে অভিযোগ আছে।

নিপ্রো নামে জাপানি কোম্পানির কাছে ১৬৪ টাকা শেয়ার বিক্রির চুক্তি করেও তা গোপন রেখে উচ্চ দরে শেয়ার বিক্রি করা হচ্ছে বলে রটিয়ে দেওয়া হয়। আর এই কারসাজির মধ্য দিয়ে ২শ টাকার শেয়ারের মূল্য এক মাসের ব্যবধানে প্রায় ৫শ টাকায় উঠে যায়।