মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ২০১০ সালের পর থেকে আজ অবধি বিভিন্ন সময় পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দিলেও বার বার দরপতনের বৃত্তে ঘূর্ণায়মান। মাঝে মধ্যে বাজারে কয়েকবার আশার আলো উকি মারলেও তা মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। তবে বর্তমান কমিশন পুঁজিবাজারে আসার পর আশার আলো দেখতে শুরু করে বিনিয়োগকারীরা। করোনা পরবর্তী পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতো শুরু করে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানামুখী পদক্ষেপে আস্থা ফিরতে শুরু করে বিনিয়োগকারীদের।

তবে গত কয়েক কার্যদিবসে টালমাতাল পরিস্থিতিতে দু:চিন্তায় পড়ে বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ পুঁজিবাজার দরপতনের কারন কি? কারা এ দরপতনকে উস্কে দিচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার এখনই খুঁজে বের করা দরকার। মুলত চার ইস্যুকে কেন্দ্র করে পুঁজিবাজার টালমাতাল বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

তেমনি মার্জিন ঋণের সুদহার বেঁধে দেওয়াকে কেন্দ্র করে জানুয়ারির শেষার্ধ থেকেই পুঁজিবাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মার্জিন ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ১২ শতাংশে কার্যকরের বিষয়টিতে পাঁচ মাসের ছাড়ও দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে এই ছাড়ের কোনো প্রভাব বাজারে পড়েনি। উল্টো মার্জিন ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজে শেয়ারের বিক্রিচাপ চলছে।

আবার নতুন করে কোনো মার্জিন ঋণও দিচ্ছে না অধিকাংশ ব্রোকারেজ হাউজ। এতে করে শেয়ারের ক্রেতা সংকট তৈরি হয়েছে। গত দুই কার্যদিবস দরপতনে ২৭০ পয়েন্ট সূচক কমেছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মাঝে। তেমনি বিষয়টি নিয়ে ভাবিয়ে তুলছে বিশ্লেষকদের। রবি ও সোমবার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে আসা বিক্রিচাপে বড় মূলধনি কোম্পানিসহ বেশিরভাগ শেয়ার দর হারিয়েছে।
তবে রাজনীতি-অর্থনীতিতে অনিশ্চিত কী এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যাতে শেয়ারের মূল্য এভাবে পড়বে, সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না বিশ্লেষকরাও।

দুই মাস চাঙাভাবের পর বাজারে কিছুটা পতন স্বাভাবিক বিষয়, যা পুঁজিবাজারে পরিচিত মূল্য সংশোধন হিসেবে। টানা পাঁচ দিন দরপতন শেষে গত সপ্তাহের শেষ দুই কার্যদিবসে যখন বাজার ঘুরে দাঁড়ায়, তখন আশান্বিত হন বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু চলতি সপ্তাহের দুই দিনে ২৭০ পয়েন্ট দরপতনের কারণ খুঁজতে হয়রান সবাই। রোববার ১৪২ পয়েন্ট পতনের পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিক্রয়ের চাপে বিএসইসি ১১ হাউজের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছিল।

বলা হয়েছিল, সোমবার থেকে আরও বেশি নজরদারি করা হবে। কিন্তু কাজে আসেনি কিছুই। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স পড়ে ১২৮ পয়েন্ট। দাম বাড়ে মাত্র ২৩টির। পতন হয় ২৩৬টির। টানা দুই দিন ১০০ পয়েন্টের মতো পতন নতুন করে বিনিয়োগ ঝুঁকি তৈরি করল। এই পতনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই আদেশ দায়ী কি না, তা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। আগের দিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তফসিলি ব্যাংকগুলোর তারল্য রক্ষায় লভ্যাংশ প্রদানের সীমা নির্ধারণ করে দেয়।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বড় পতনে ভূমিকা রেখেছে শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউজ। এসব হাউজ থেকে বিক্রিচাপ আসায় গত দুই কার্যদিবসে সূচকের বড় পতন হয়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে ডিএসইর প্রধান সূচক ৬ হাজার পয়েন্টের কাছাকাছি উন্নীত হওয়ায় অনেক শেয়ারের দর বেড়েছে। মার্জিন ঋণ সংকটের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা মূলধনি মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। গত দুই কার্যদিবসে বড় পতনে এটিই প্রধান কারণ।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মার্জিন ঋণের সুদহার ১২ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণার পর থেকেই পুঁজিবাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা কার্যকরের কথা থাকলেও ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের দাবির মুখে তা পাঁচ মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়।

তবে এরপর থেকে ব্রোকারেজ হাউজগুলো নতুন করে কোনো মার্জিন ঋণ দিচ্ছে না বলে জানা গেছে। বিপরীতে ঋণের সুদহার ১২ শতাংশে নামিয়ে আনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন শেয়ার বিক্রি করে তা সমন্বয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এর ফলে নতুন করে ক্রেতা সংকট তৈরি হয়েছে।

এ ছাড়া সূচকের বিভিন্ন স্তরভিত্তিক মার্জিন ঋণ দেওয়ার যে পদ্ধতি চালু করেছে বিএসইসি, সেটিও প্রচলিত নয় বলে অভিযোগ করেছে ব্রোকারেজ হাউজগুলো। এটিও প্রত্যাহারের চাপ রয়েছে। তবে সূচকের বড় পতনের মাধ্যমে বিএসইসির ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

পুঁজিবাজারে যাতে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা না দেয়, সে জন্য নজরদারি আরও জোরদারের কথা জানিয়েছেন বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম। তিনি জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে বড় দরপতন হওয়ার কোন কারন দেখছেন না। তারপরও সূচকের বড় দরপতন খুঁেজ দেখছি। এ ধরনের পতন আমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। কেউ কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বিক্রিচাপ বাড়িয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখছি।

এতে বলা হয়, সবচেয়ে ভালো মানের ব্যাংকগুলো গত ডিসেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ১৫ শতাংশ নগদসহ ৩০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিতে পারবে। এ জন্য ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণসহ অন্যান্য খরচ বাদে ১৫ শতাংশ বা তার বেশি মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে। ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ব্যাংকের ন্যূনতম মূলধন ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার বিবেচনায় সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে। তবে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। গত বছরের মে মাসে আরেক প্রজ্ঞাপনে ব্যাংকগুলোর মুনাফা যথাসম্ভব অবণ্টিত রেখে মূলধন শক্তিশালী করতে বলা হয়েছিল।

তবে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ মনে করেন না এ কারণেই এই পতন। বলেন, ‘ব্যাংকের জন্য ৩০ শতাংশ বোনাস ঠিকই আছে। খুব কম ব্যাংকই ৩০ শতাংশ বোনাস দিচ্ছে। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং সেক্টরের সুরক্ষার জন্য করেছে। আমার মনে হয় না এ সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারকে খুব বেশি প্রভাবিত করবে।’ তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্র চারটি ব্যাংকের শেয়ার দর বেড়েছে। তিনটি ব্যাংকের দর পাল্টায়নি। বাকি সবগুলো ব্যাংকের শেয়ারের দর কমেছে।

তবে পতন কেবল ব্যাংকের হয়নি। গত কয়েক মাস ধরে আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা বিমা কোম্পানিগুলো দর হারিয়েছে ব্যাপক হারে। তালিকাভুক্ত ৪৯টি কোম্পানির মধ্যে মাত্র তিনটি কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছে। আর দুটি কোম্পানির শেয়ার দর পাল্টায়নি। বাকি সব শেয়ারের দর কমেছে।