এফ জাহান ও তৌফিক ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা:  পুঁজিবাজারে দরপতন থামছে না। ফলে বিনিয়োগকারীদের মাঝে দিন দিন হতাশা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। পুঁজিবাজারের ভবিষ্যত নিয়ে ফের শঙ্কায় পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। দিন যতই যাচ্ছে লোকসানের পাল্লা ততই ভারী হচ্ছে। এ অবস্থায় নীতি নির্ধারকদের কথায় আশার আলো দেখছে না বিনিয়োগকারীরা।  সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে লেনদেন আবার হতাশ করল বিনিয়োগকারীদের। প্রায় ২০০ কোম্পানির দরপতনে টাকা হারিয়ে পতনের কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারা।

কিন্তু না নিয়ন্ত্রক সংস্থা, না স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ, না বাজার বিশ্লেষক-কেউ সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে লোকসান গুনে শেয়ার ছেড়ে দেবেন নাকি ধরে রেখে আরও দরপতনের ঝুঁকি নেবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না কেউ। ফলে বার বার নীতি নির্ধারকদের কথায় বিনিয়োগ করে পুঁজি হারাচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। গত কয়েক কার্যদিবসের দরপতনে বিনিয়োগকারীরা তাদেও মুল পুঁজির ৫০ শতাংশ হারিয়েছে। এ অবস্থায় চলতে থাকলে পুঁজি শেষ হতে আর বেশি দিন লাগবে না।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উত্থান-পতন পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক নিয়ম হলেও সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলা যাবে না। একদিন লাফিয়ে উঠলেও পরদিনই ধপাস করে পড়ে যাচ্ছে দর। এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন বড় খেলোয়াড়রা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নানা পদক্ষেপের কথা বললেও কার্যত সিন্ডিকেটের লাগাম টানতে পারেনি।

সম্প্রতি ১১টি ব্রোকারেজ হাউসকে সন্দেহজনক আচরণের দায়ে চিহ্নিত করলেও তাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। এর মধ্যে ৪টি হাউসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা শোনা গেলেও এর সত্যাসত্য নিশ্চিত করেনি বিএসইসি। শেয়ারবাজার নিয়ে প্রভাবশালী খেলোয়াড়দের এই কারসাজিরই খেসারত দিতে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। আর কারসাজির হোতারা কামিয়ে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাভাবিক গতিতে চলছে না পুঁজিবাজার। কারসাজি হচ্ছে। যার পরিণতিতে হুট করে বাজারের অস্বাভাবিক উত্থান-পতন। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। বিগত সময়ে যেভাবে পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, সেখানে হঠাৎ করে সূচকের পতন অস্বাভাবিক। বিনিয়োগকারীদের ধারণা ছিল, সূচক ৫ হাজার ৯০০-এর মধ্যে থাকবে। কিন্তু সূচক এখন ৫ হাজার ৪৪৭ তে নেমেছে। ফলে অনেক বিনিয়োগকারী হতাশ। এর কিছু কারণও আছে। আগে শেয়ার দর বাড়ার ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট ট্রেডিং কিংবা সিরিয়াল ট্রেডিং কাজ করেছে।

যে কারণে স্থায়ী হয়নি শেয়ারের দাম। অনেক কোম্পানি আইপিওতে আসার পর শেয়ারের দর সাত গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। এছাড়া আইপিওর শেয়ার নিয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা হুজুগে শেয়ার কিনেছেন। এখন সেই দাম নেই, অনেক কমে গেছে। জোয়ারের মতো কয়েকটি শেয়ারের দর বেড়েছে। আর যখন ভাটা পড়েছে, তখন মাথায় হাত। আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দ্রুত মুনাফার লোভে গুজবের ফাঁদে পা দিয়ে কিছু কোম্পানির শেয়ার কিনছেন।

অথচ এসব কোম্পানি সম্পর্কে তাদের ভালো ধারণা নেই। কিছু দিন আগে তারা বিমা খাতের পেছনে ছুটেছেন। এ খাতের শেয়ারের দর তিন-চার গুণ বেড়েছে। বিমার শেয়ার দর সে জায়গায় এখন আর নেই। তারপর তারা ছুটেছেন মিউচুয়াল ফান্ডে। সেটার দর বাড়ার পর শেষ পর্যন্ত টেকেনি। সব বিনিয়োগকারী মিউচুয়াল ফান্ড বিক্রি করে বের হয়ে গেছেন। তারপর যান আইপিওতে, তখন প্রায় সবগুলোর দর তিন-চার গুণ বাড়লেও শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়নি। রবির শেয়ার বেড়ে হয়েছিল সাত গুণ। এছাড়া বর্তমান বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ারের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

পুঁজিবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপকালে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে বর্তমান অবস্থা খারাপ দিকে যাচ্ছে। গত কয়েক কার্যদিবসের দরপতনে বিনিয়োগকারীরা কিছুটা দু:চিন্তায় পড়ছেন। তবে আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি ঠিক নয় বলে তিনি মন্তব্য করছেন।

ডিবিএর সাবেক সভাপতি ‘শাকিল রিজভী স্টক’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী বলেছেন, নতুন কোম্পানি বাজারে আসার পর সার্কিট ব্রেকারের কারণে দাম ৫০ শতাংশ করে বাড়ে। তিনদিন পর যখন মানুষ এই নতুন শেয়ার বিক্রি করতে যায় তখন সেই শেয়ারের দাম কমে যায়। বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য সার্কিট ব্রেকার নিয়ে চিন্তা করা উচিত। কারন নতুন কোম্পানি বাজার তালিকাভুক্ত হয়ে দশ টাকার শেয়ার ৭০ টাকায় চলে যায়।

যখন বেশি বিনিয়োগকারী এই শেয়ারে বিনিয়োগ করতে আসেন, তখন দাম কমতে থাকে, যা দেখেছি আমার এনার্জিপ্যাক ও রবির শেয়ারের ক্ষেত্রে। তাই এখনই সার্কিট ব্রেকার নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে। গত মাসে অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে পুঁজিবাজার। যখন বাজার বাড়ে তখন বিনিয়োগকারীদের বিক্রির চাপ আসে। এই চাপ সামাল দিতে পারে না পুঁজিবাজার। যার কারণে হুড় মুড়িয়ে উত্থান-পতন হচ্ছে। অর্থাৎ যেমন বাড়ছে তেমনি কমছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বর্তমান পরিচালক রকিবুর রহমান বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারের উত্থান স্বাভাবিক হলেও পতন ছিল অস্বাভাবিক। পুঁজিবাজার যাদের স্থিতিশীত করার দায়িত্ব তারাই ব্যবসা করছে। আইসিবি বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য কাজ করার কথা থাকলেও তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিভিন্ন ইকুইটিতে বিনিয়োগ করেছে, যা আইসিবির কাজ নয়। এছাড়া নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। যার কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা তৈরি হয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন শেয়ার বিনিয়োগ করেন। এতে বাজারের অবস্থা ভালো হতে থাকে। কিন্তু পরবর্তী সময় হুট করে এমন পতন একেবারে অনাকাক্সিক্ষত।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারের উত্থান-পতন স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে হুট করে এমন উত্থান আবার দ্রুত সূচকের পতন স্বাভাবিক নয়। এ বিষয় নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। এই বাজারে বিনিয়োগকারীদের বুঝেশুনে বিনিয়োগ করার পরামর্শ বিএসইসির সাবেক এই চেয়ারম্যানের।