দেশ প্রতিক্ষণ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটিকে ‘অযোগ্য’ দাবি করে সম্মেলনের দাবিতে অজ্ঞাত পরিচয়ে ব্যানার সাঁটানোর ঘটনায় বেজায় চটেছেন নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী। আওয়ামী লীগে ‘মুসলিম লীগের বাচ্চাদের’ অনুপ্রবেশ ঘটেছে দাবি করে দলের প্রবীণ এই নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সেসব কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নগরজুড়ে এসব ব্যানার লাগানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুই ধারায় বিভক্ত। এর মধ্যে একটি অংশ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। মহিউদ্দিনের অবর্তমানে এই অংশের নিয়ন্ত্রণে আছেন তার সন্তান শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। আরেকটি অংশ সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী।

একসময় মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর পরিচিতি থাকলেও মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর দলের সাধারণ সম্পাদকের সখ্য বিবেচনায় ইদানিংকালে তাকে আ জ ম নাছির বলয়ের লোক হিসেবে ধরা হয়। ২০১৩ সালের ১৪ নভেম্বর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সভাপতি এবং আ জ ম নাছির উদ্দীনকে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর মারা যান মহিউদ্দিন। এরপর ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী।

গত কয়েকদিন ধরেই ‘চট্টগ্রাম মহানগর তৃণমূল আওয়ামী লীগ’ নামে নগরের শতাধিক স্পটে ব্যানার সাঁটানো হয়েছে, যাতে অনতিবিলম্বে মেয়াদোত্তীর্ণ অযোগ্য-অকেজো কমিটির বিলুপ্তি চাওয়া হয়েছে এবং দ্রুত নতুন কমিটি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। ব্যানার সাঁটানোর সঙ্গে কারা জড়িত— সেটি জানা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে সম্মেলনপ্রত্যাশী মাহতাব-নাছিরবিরোধী অংশটিই এর সঙ্গে জড়িত।

শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে নগর আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে মাহতাবউদ্দিন চৌধুরী তার পুরো অংশজুড়েই ‘চট্টগ্রাম মহানগর তৃণমূল আওয়ামী লীগ’ নামের এই হঠাৎ গজিয়ে সংগঠন ও এর পেছনে থাকা সন্দেহভাজন নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়েন।

আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে সেই ব্যানারের প্রসঙ্গ তুলে মাহতাবউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘একটা পত্রিকায় দেখেছি নগরে ব্যানার লাগানো হয়েছে আমাদের কমিটি অযোগ্য কমিটি। আমাদের এই অযোগ্য কমিটিতে সাবেক গণশিক্ষা মন্ত্রী আফসারুল আমিন, বর্তমান শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, সাবেক সিটি প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন, আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক রয়েছেন।’

এই ধরনের ব্যানার সাঁটানো ব্যক্তিদের ‘মুসলিম লীগের বাচ্চা ও কুচক্রী’ উল্লেখ করে মাহতাব বলেন, ‘আমি বলবো এই অযোগ্য কমিটির কথা পত্রিকায় না দিয়ে দলীয় ফোরামে আনা ভাল ছিল। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করে লাভ নাই। এটা কে করেছে কারা করেছে জানি না, তবে আজ বলতে হয় যারা আমার পিতাকে লালদীঘির ময়দানে, চন্দনপুরায় লাঞ্ছিত করেছিল সেই মুসলিম লীগের বাচ্চারা আজকে অনুপ্রবেশ করেছে আওয়ামী লীগের মধ্যে। তারা সেই কুচক্রী মহল। যদি আওয়ামী লীগ করতো তারা এগুলো কোনদিনও করতো না।’

মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষস্থানীয় সংগঠক ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর জহুর আহমদ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র।

বিনা কারণে তাকে বেইজ্জত করা হচ্ছে দাবি করে মাহতাব বলেন, ‘আমি তো ভাল লোকের ছেলে, আমি একজন সম্মানী লোকের ছেলে। আমি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ছেলে। কোনদিকে খাটো আমি? আমাকে কেন বেইজ্জত করছেন? আমাকে নিয়ে সমালোচনা, আমার কমিটি নিয়ে সমালোচনা, আমার সহকর্মীদের নিয়ে সমালোচনা। এই কষ্ট কোথায় রাখবো আপনারা বলেন। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছে বিচার দিলাম।’

আড়ালে কাদা ছোড়াছুড়ি না করে কেউ তার অব্যাহতি চাইলে অব্যাহতি নেবেন এমন কথা উল্লেখ করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একজন মুক্তির সৈনিক হিসেবে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলছি আমি তো কারও কাছে কোনো অপরাধ করিনি। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে আপনাদের অনুরোধ করতে চাই, যাদের আমাকে খারাপ লাগে তারা আসুন আমাকে বলুন আমার অব্যাহতি চান, আমি অব্যাহতি দেবো। এগুলো করার তো কোন মানে নাই।’

কোনো সম্মেলন নয়, শুধু প্রধানমন্ত্রী চান না বললেই পদ ছেড়ে দেবেন জানিয়ে মাহতাব বলেন, ‘নেত্রী বলুক মাহতাবকে আমি চাই না, নাছিরকে আমি চাই না। আমরা সসম্মানে চলে যাব। আমার কোন খায়েশ নাই। আওয়ামী লীগ করে বাড়ি করি নাই, নারী লোভে পড়ি নাই, ধন সম্পদ লুট করি নাই, ভূমিদস্যুতা করি নাই। সৎভাবে চলেছি। ৭৫-এর পরে মার খেয়েছি, জেল খেটেছি। অনেক আন্দোলন করেছি।’ শুধু মাহতাব উদ্দিন নয় এমন প্রচার প্রচারণা মেনে নিতে পারছেন না নগর আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মীই।

মাহতাব উদ্দিনের ক্ষোভের সাথে একমত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে নগর আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, ‘একমত তো বটেই, আমি ব্যানারগুলোর কথা শুনেছি। যেগুলোতে বলা হয়েছে মহানগর কমিটি অযোগ্য। আমরা এই কমিটি দুটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও একটা জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করলাম। তিন নির্বাচনেই আমাদের দলীয় এচিভমেন্ট আছে। করোনা কালেও আপনি দেখবেন প্রথম দিন থেকে কঠিন সে সময়ের পুরোটা জুড়েই নগর আওয়ামী লীগ মাঠে ছিল।’

তিনি বলেন ‘মাহতাব ভাইর বয়সটা দেখুন। করোনার সময় বয়স্কদের বিষয়ে বিশেষ সতর্কতার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী তো সবকিছুতে সক্রিয় ছিলেন। মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে তিনি রাস্তায় ছিলেন, মানুষকে সেবা দিলেন এবং নির্বাচন পরিচালনা করলেন। কোন্ যুক্তিতে এটাকে অযোগ্য কমিটি বলা হলো?’

তাছাড়া এসব ব্যানার যারা দিয়েছে তারা মূলত দলীয় সভানেত্রীর সাথেও বেয়াদবি করেছে মন্তব্য করে ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, ‘নগর আওয়ামী লীগের কমিটি যোগ্যতা অযোগ্যতা দেখবার বিচার করবার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের, আমার সভানেত্রীও প্রধানমন্ত্রী। যে কোন লোক যে কোন কথা বলতেই পারে। বলা কোন বিষয় না।’

যারাই করুক কাজটা ঠিক হয়নি মন্তব্য করে প্রখ্যাত এই আইনজীবী বলেন, ‘কেউ যদি মনে করেন যে উনি সম্মেলনে সভাপতি, সেক্রেটারি কিংবা সাংগঠনিক সম্পাদক হবেন তাহলে উনি তো পজিটিভ ওয়েতে আগাতে পারেন। উনারা দাবি করতে পারেন, প্রেস কনফারেন্স করতে পারেন যে এখানে সম্মেলন চাই। আমি বিশ্বাস করি, এটা আমাদের রাজনৈতিক চেতনায় বিশ্বাসী কোন লোক করে নাই। যারাই এটা করেছেন তাদের মধ্যে কোন রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা বা ভাবাদর্শ নাই। উনি আপেক্ষিক রাজনীতি করেন কিছু পাওয়ার আশায়।’