এফ জাহান ও তৌফিক ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে টানা দরপতনের কারন কি? এ প্রশ্ন এখন বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন দেশের অর্থনীতি সব সূচক যেখানে ভালো, দেশে নেই কোনো সহিংসতা, তারপরও পুঁজিবাজারে টানা দরপতন ঘটছে। এ দরপতনের পেছনে কি রহস্য তা নিয়ন্ত্রন সংস্থার খতিয়ে দেখা উচিত।

কারন নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি বিনিয়োগকারীদের যে আস্থা ছিল টানা দরপতনে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। তবে বর্তমান বাজারে মার্কেট প্লেয়ার যারা তারা সঠিক দায়িত্ব পালন করছে কি না সেটা দেখা উচিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বাজার বিশ্লেষক, ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারী কেউই পুঁজিবাজারে টানা দরপতনের সুনির্দিষ্ট কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। গত ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত উত্থানে যারা বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরার আশা করছিলেন, তারা হতাশ। দিনে দিনে বাড়ছে এই হতাশা।

পুঁজিবাজারে এমন টানা দরপতন দেখা দিলেও তাকে স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত মনে করছেন না বিশেষজ্ঞ ও বাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বর্তমানে সুদের হার বেশ কম। দেশের অর্থনীতিও ভালো অবস্থানে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে এমন টানা দরপতন দেখা দেয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাদের পরামর্শ, বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরতে হবে।

অকারণে প্যানিক সেল করা ঠিক হবে না। আর যেমন তেমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করে, ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে হবে। এখন বেশকিছু ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম কমে গেছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এসব কোম্পানি বাছাই করে দীর্ঘমেয়াদের জন্য বিনিয়োগ করতে পারেন।

এদিকে টানা ধস দেখা দিয়েছে দেশের পুঁজিবাজারে। সপ্তাহের তৃতীয় কার্যদিবসে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সবকটি মূল্য সূচকের বড় পতন হয়েছে। এর মাধ্যমে টানা পাঁচ কার্যদিবস পতনের মধ্যে থাকল পুঁজিবাজার। টানা দরপতনের পাশাপাশি লেনদেনেও খরা দেখা দিয়েছে।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, সপ্তাহের তৃতীয় কার্যদিবসে লেনদেন শেষে সূচকের বড় পতন হলেও লেনদেনের শুরুতে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ে। এতে প্রথমদিকে সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাও দেখা দেয়। প্রথম ১৫ মিনিটের লেনদেনে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ২২ পয়েন্ট বেড়ে যায়। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের দাম বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকায় লেনদেনের প্রথম দেড় ঘণ্টা সূচক ঊর্ধ্বমুখী থাকে। তবে বেলা সাড়ে ১১টার পর একের পর এক প্রতিষ্ঠানের দাম কমতে থাকে।

ফলে নিম্নমুখী হতে থাকে সূচক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পতনের এই মাত্রা বাড়তে থাকে। এতে লেনদেন শেষে ধসে পরিণত হয় শেয়ারবাজার। দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে মাত্র ৬৬টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট। বিপরীতে পতনের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ১৫৬টি। আর ১১৭টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।

বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের দাম কমায় একদিনেই তিন হাজার কোটি টাকার ওপরে মূলধন হারিয়েছে ডিএসই। দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৫৭ হাজার ৪ কোটি টাকা। যা আগের কার্যদিবস শেষে ছিল ৪ লাখ ৬০ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এ হিসেবে বাজার মূলধন কমেছে ৩ হাজার ৭৬ কোটি টাকা।

অপরদিকে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৬৭ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৩১৭ পয়েন্টে নেমে গেছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই-৩০ আগের দিনের তুলনায় ৩৯ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ১৭ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আর ডিএসইর শরিয়াহ্ সূচক ১৫ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ২০৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

আমতলী বকুল নেছা মহিলা কলেজের প্রভাষক ও অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী কাজী হোসাইন আলী বলেন, ‘ পুঁজিবাজারের বর্তমান আচরন মোটেই কাম্য নয়। বর্তমান পুঁজিবাজারের আচরন দেখে মনে হচ্ছে অদৃশ্য কোন শক্তি খেলছে। কারন নিয়ন্ত্রক সংস্থা পুঁজিবাজার উন্নয়নে যে ভাবে কাজ করছে সেখানে এরকম দরপতন আমরা আশা করতে পারি না।

তাছাড়া পুঁজিবাজারে উত্থান-পতন থাকবে। এটা যারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন তারা সবাই জানেন। কিন্তু ক্রমাগত দরপতন হলে সেটা প্রত্যাশিত নয়। কারণ, পুঁজিবাজারে এক গ্রুপ শেয়ার কিনবে, আরেক গ্রুপ শেয়ার বিক্রি করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শেয়ার বিক্রির পর দর কমে যায়, তখন কারা কিনবে। তারা এখন কোথায়?’

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক। তবে পুঁজিবাজার অস্বাভাবিক হওয়ার মত কোন কারন দেখছি না। এই দরপতনের যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ আমি দেখি না। বিনিয়োগকারীরা কেন আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করছে আমি বুঝি না। অনেক ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম কমে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এখন দেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থানে রয়েছে। সুদের হারও বেশ কম। এই সবকিছুই পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক। আমি মনে করি, দাম কমে যাওয়ায় এখন বিনিয়োগকারীদের কেনা উচিত। তবে যেই-সেই কোম্পানির শেয়ার কেনা যাবে না। অবশ্যই ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে। ব্যাংকে টাকা রাখলে এখন যে রিটার্ন পাওয়া যাবে, শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে তার থেকে বেশি রিটার্ন পাওয়া যাবে।

ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পুঁজিবাজার খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এখন মার্চেন্ট ব্যাংক, আইসিবিকে হাল ধরতে হবে। তা না হলে শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার ওপর চাপিয়ে বেশি দূর যাওয়া যাবে না।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, এখন বাজার খারাপ হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তবে এখন একটি কোম্পানির আইপিও আবেদন চলছে। এতে কিছু বিনিয়োগকারী টাকা তুলে নিয়ে আইপিও আবেদন করছেন। বাজারে নেতিবাচক প্রবণতার জন্য এটি একটি কারণ হতে পারে। তারপরও ব্যাংকের সুদহার এখন বেশ কম। এটা পুঁজিবাজারের জন্য ভালো সংবাদ। আমাদের ধারণা আগামী সপ্তাহ থেকেই হয়ত বাজার ভালো হবে।