দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক কোম্পানিগুলো এ বছর শেয়ারধারীদের ১৫ শতাংশের বেশি নগদ লভ্যাংশ দিতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য লভ্যাংশের এ হার বা সীমা বেঁধে দিয়েছে। আর্থিক খাতের লভ্যাংশ ইস্যুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন হঠাৎ হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও শেয়ারহোল্ডাররা। তারা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক একের পর এক পুঁজিবাজার ইস্যুতে হঠকারী সিদ্ধান্তে পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করছে।

ফলে বাজারের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীরা প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝুঁকি মোকাবিলায় বিনিয়োগ সীমা, প্রভিশন সংরক্ষণের বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠান লাভ করলে সেখানে থেকে কত লভ্যাংশ দেবে, সেটা সেই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিষয়। এখানে সীমা বেধে দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।’

এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠান যে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, তা দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আইডিএলসি ফিন্যান্স শেয়ারপ্রতি সাড়ে তিন টাকা লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়ে দিয়েছে কোনো অবস্থাতেই শেয়ার প্রতি দেড় টাকার বেশি লভ্যাংশ দেয়া যাবে না। একইভাবে আইপিডিসি ফিন্যান্স শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ২০ পয়সা আর বিডি ফিনান্স ৬০ পয়সা নগদ ও প্রতি ১০০ শেয়ারে ছয়টি করে বোনাস শেয়ার দিতে পারবে কি না, সেটিও নিশ্চিত নয়। তারা শেয়ারপ্রতি দেড় টাকার নিচে লভ্যাংশের প্রস্তাব করলেও বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত নীতিমালায় আরও বেশ কিছু শর্তের কারণে এই প্রশ্ন উঠেছে।

ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানিয়েছে, যেসব আথিক প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকৃত বা খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের বেশি রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করবে না। যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন পর্যাপ্ততার হার ১০ শতাংশের কম এবং খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের এর বেশি, সেসব প্রতিষ্ঠান কোনো লভ্যাংশ দিতে পারবে না।

যেসব আথিক প্রতিষ্ঠান সংরক্ষিতব্য সংস্থান (প্রভিশন সংরক্ষণ) না রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক হতে ঘাটতি সমন্বয় করে ডেফারেল সুবিধা (প্রভিশন সংরক্ষণে অতিরিক্ত সময় না নেয়া) ভোগ করছে, তারা সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে দিতে পারবে। এই নীতিমালা জারির আগেই তিনটি প্রতিষ্ঠান লভ্যাংশ ঘোষণা করে ফেলার পর কর্মকর্তারা নিশ্চিত হতে পারছেন না, এই নীতিমালা তাদের ওপর প্রযোজ্য হবে কি না। আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে ১৭ ফেব্রুয়ারি, আর এক সপ্তাহ পরে ২৪ ফেব্রুয়ারি নীতিমালা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন।

কোম্পানিগুলো বোর্ড সভায় যে লভ্যাংশ ঘোষণা করে, সেটি অবশ্য চূড়ান্ত নয়। বার্ষিক সাভারণ সভায় শেয়ারধারীরাই তা অনুমোদন করে। বাংলাদেশে ঘোষিত লভ্যাংশ পরিবর্তনের ইতিহাস বিরল হলেও একেবারে যে হয়নি, এমনও নয়। আইডিএলসি ও বিডি ফিন্যান্সের ৩১ মার্চ ও আইপিডিসির বার্ষিক সাধারণ সভার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ৪ এপ্রিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনার আগেই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। আইডিএলসি ফিন্যান্স ২০২০ সালের জন্য ৩৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনার পর এখন ঘোষিত এ লভ্যাংশের কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

এ বিষয় জানতে চাইলে আইডিএলসি ফিন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ খান বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান যখন লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, তখন এ ধরনের কোনো বিধান ছিল না। এখন নতুন বিধান করায় বিষয়টি নিয়ে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করব।’

আইডিএলসি ফিন্যান্সের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মাসুদ করিম বলেন, ‘বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক এমন নীতিমালা জারি করেছে। কিন্তু তার আগেই আমরা লভ্যাংশ ঘোষণা করেছি। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মনে করে, আগে ঘোষিত লভ্যাংশ এই নীতিমালার বাইরে থাকবে তাহলে তো সমস্যা নেই। ‘তারপরেও আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করব। এর মাঝে যদি কোনো সিদ্ধান্ত হয় তাহলে তা অবশ্যই বিনিয়োগকারীদের জানানো হবে।’

বিডি ফিন্যান্সের কোম্পানি সচিব মুন্সি আবু নাঈম বলেন, ‘আমরা ৬ শতাংশ নগদ ও ৬ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় শর্ত সাপেক্ষে ৫ শতাংশ পর্যন্ত বোনাস লভ্যাংশ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এখন আমরা ৬ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে পারব কি না, সেটি দেখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সিদ্ধান্তের জন্য বার্ষিক সাধারণ সভা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি আমাদের চিঠি দেয় যে, যে নীতিমালা অনুযায়ী লভ্যাংশ ঘোষণা করতে হবে, তাহলে তাই করা হবে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘নীতিমালা যেহেতু জারি করা হয়েছে, সেটা সবার জন্য মানা করা আবশ্যক। যারা ইতিমধ্যে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে তাদেরও মানতে হবে।

বাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তকে অযাচিত বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝুঁকি মোকাবিলায় বিনিয়োগ সীমা, প্রভিশন সংরক্ষণের বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠান লাভ করলে সেখানে থেকে কত লভ্যাংশ দেবে, সেটা সেই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিষয়। এখানে সীমা বেধে দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।’

এই ঘোষণায় বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আইডিএলসি যখন লভ্যাংশ ঘোষণা করল, তখন বিনিয়োগকারীরা ৭০ টাকার বেশি দামে আইডিএলসির শেয়ার কিনেছে। বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ হিসাব করেই নতুন বিনিয়োগ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের পর এক দিনে দাম কমল ৩ টাকা ৩০ পয়সা। এখন তাদের লোকসানের দায় কে নেবে?’

পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারন সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলেন, পুঁজিবাজার ইস্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একের পর এক হঠকারী সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। মুলত যাদের সক্ষমতা নেই তারা যদি লভ্যাংশ দেয়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের আটকাতে পারে। কিন্তু যে কোম্পানির সক্ষমতা আছে তাকে তা দিতে দেয়া উচিত।

সব প্রতিষ্ঠানের জন্য একধরনের সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারের জন্য ভালো হবে না।’ তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষায় থাকেন বছর শেষে কোম্পানি ভালো লভ্যাংশ দেবে। এটাই দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের কারণ। কিন্তু সেখানেও যদি বাধা দেয়া হয় তাহলে সার্বিক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে।’