এফ জাহান ও তৌফিক ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে দেশের পুঁজিবাজারে বড় ধস হয়েছে। তবে হঠাৎ পুঁজিবাজারের এমন আচরনে সকল মহলে নতুন শঙ্কা বিরাজ করছে। এর মাধ্যমে টানা দুই কার্যদিবস ধসের মধ্যে থাকল পুঁজিবাজার। এই টানা ধসের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এদিকে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার স্বার্থে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানামুখী উদ্যোগের পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।

ফলে সকলের মাঝে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাছাড়া বর্তমান বাজারে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই নিম্নমুখী হচ্ছে বাজার। সেই সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই কমছে বাজার মূলধন। বিষয়টি যেমন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভাবিয়ে তুলছে, ঠিক তেমনি বাজার সংশ্লিষ্টদের কাছে এর প্রকৃত কারণ অজানাই রয়ে গেছে। আর এ কারনে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন।

এদিকে গতকাল পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু হতেই বিক্রির চাপ দেখা দেয়ায় সূচকের নেতিবাচক প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিক্রির এই চাপ বাড়তে থাকায় সূচকের পতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। দিনের লেনদেন শেষে প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সবকটি মূল্য সূচকের বড় পতন হয়। সেই সঙ্গে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা বাজার মূলধন হারিয়েছে ডিএসই।

অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমায় দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আগের কার্যদিবস শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ৭২ হাজার ৯৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ৭ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা। এর মাধ্যমে টানা দুই দিনের ধসে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ১৩ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। বাজার মূলধন বাড়া বা কমার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম সম্মিলিতভাবে ওই পরিমাণ বেড়েছে বা কমেছে।

এদিকে হঠাৎ করে করোনার প্রভাব বাড়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্য গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে, দেশে আবারও লকডাউন আসতে পারে। এতে পুঁজিবাজারসহ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়বে। তাই হাতে নগদ অর্থ রাখার জন্য বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা দেখা গেছে।

এছাড়া সাধারণ বিনিয়োগকারীদের চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বড় বিনিয়োগকারীরা বেশি শেয়ার বিক্রি করে প্যানিক সৃষ্টি করছেন। যে কারণে আবারও বেসামাল হচ্ছে পুঁজিবাজার। রোববার লেনদেনের শুরু থেকে শেষ পর্যাপ্ত অহেতুক বিক্রির চাপ অব্যাহত থাকে। মূলত বিনিয়োগকারীদের এই বিক্রির চাপেই পুঁজিবাজারে ধস নেমেছে। করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি আর পুঁজিবাজারে পতন যেন সমানুপাতিক।

বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে বড় পতন হয় নতুন করে লকডাউন ও লেনদেন স্থগিতের গুজবে। আর রোববার সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে আগের দিনের চেয়েও বেশি পতন হলো আবার ছুটির আলোচনায়। লকডাউন হচ্ছে না এটা সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করার পর এটি নিয়ে আর আলোচনা নেই।

তবে স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, গত বছরের মতোই সাধারণ ছুটি ঘোষণা হতে পারে। সকাল ১০টায় লেনদেন শুরু হওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে সূচক পড়ে যায় ৭৪ পয়েন্ট। এক পর্যায়ে বেলা দুইটায় সূচক পড়ে যায় ৯৬ পয়েন্ট। শেষ পর্যন্ত আগের দিনের চেয়ে ৮৪ পয়েন্ট কমে শেষ হয় লেনদেন। সূচকের পাশাপাশি কমেছে লেনদেনও।

লেনদেনের পরিমাণ ৬১৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে যা ছিল ৬৪৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। হাতবদল হওয়া কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ৩১টির, কমেছে ২৩৯টির আর দর পাল্টায়নি ৭৮টির। হঠাৎ পুঁজিবাজারে কী হয়েছে, তা বুঝে উঠতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিও। এই অবস্থায় তারা বৈঠকে বসছে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, ডিবিএর সঙ্গে।

পুঁজিবাজারের এই দরপতন সম্পর্কে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, পুঁজিবাজারে এখন দরপতনে কোনো কারণ নেই। তবে বিভিন্ন জায়গায় কথা বলে জানতে পেরেছি করোনাভাইরাস নিয়ে নতুন করে দেখা দেয়া আতঙ্কের কারণেই দরপতন হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, শেয়ারবাজারে যেভাবে দরপতন হচ্ছে তাতে আমরা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত। এরপরও বিনিয়োগকারীদের বলবো কেউ প্যানিক সেল করবেন না। প্যানিক সেল না হলে বাজার সহসা ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, ‘করোনার কারণে পুঁজিবাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে যেভাবে কমেছে সূচক ও লেনদেন সেটা কাঙ্খিত না। বরং পুঁজিবাজারে আরও ভালো থাকার কথা।’ ‘প্রতিনিয়ত পতন দেখতে দেখতে বিনিয়োগাকরীরাও আতঙ্কে পড়ে গেছে। ফলে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না।’

তবে আশাবাসী ভিআইপিবি অ্যাসটে ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহিদুল ইসলাম। ‘বর্তমানে অনেক কোম্পানির শেয়ার দর তলানিতে। বাজারের এমন অবস্থায় পতন খুব বেশি দীর্ঘ হবে বলে মনে হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘সব কোম্পানির শেয়ার এখন কেনার উপযোগী। সব পক্ষের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলে শিগগিরই এমন নেতিবাচক অবস্থা কেটে যাবে।’

ডিএসইর এক সদস্য বলেন, এখন বাজারে যে দরপতন হচ্ছে তার জন্য বড় বিনিয়োগকারী এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ জড়িত। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির উচিত ঊর্ধ্বমুখী বাজারে কারা শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছে তাদের খুঁজে বের করা। সেই সঙ্গে তাদেরকে আবার বিনিয়োগ করতে বাধ্য করতে হবে। তা না হলে এই বাজারের ওপর থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা উঠে যাবে।