আহসান আমীন: স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ। পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্জন কতটুকু? স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে কি-না এমন প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার বিষয়ে নানা মহলের প্রশ্ন থাকলেও ৫০ বছরে দেশের অর্জন কম নয়। ত্রিশ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে রক্তস্নাত সদ্য স্বাধীন এ ভূখণ্ডে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা ছিল জনগণের নিত্যসঙ্গী।

যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি, নেই বৃহৎ কোনো অবকাঠামো, কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, গুটিকয়েক শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সেবা খাত গড়ে না ওঠা শুরুর গল্পটা অনেকটাই ছিল এ রকম। খুবই সাধারণভাবে যাত্রা শুরু করা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তাই নানা রকম হোঁচট খেয়েই পথ চলতে হয়।

দারিদ্র্যপীড়িত ও শিক্ষাহীন জনগোষ্ঠী, সীমিত কর্মসংস্থানের সুযোগসহ নানা কারণে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের নেতিবাচক উপাধিও জুটে যায় বাংলাদেশের কপালে। যদিও এ পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে অনেকটা সময় লেগে যায়। দুই দশক আগেও মনে করা হতো বাংলাদেশের অর্থনীতি হয়তো উন্নতি করতে পারবে না। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় হয়তো এগিয়ে যেতে পারবে না বাংলাদেশ।

যদিও ঘটেছে ঠিক তার উল্টো। মাত্র ৮ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনীতি নিয়ে ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। প্রধান রপ্তানি পণ্য শুধু পাট ও চা। বার্ষিক বাজেট ৭৮৬ কোটি টাকা। এর সিংহভাগই আবার বিদেশি অনুদান। মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলার। জীবনের আয়ুষ্কাল মাত্র ৪৭ বছর। বেকারত্বের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। দীর্ঘ সময়ে শোষণে নিষ্পেষিত জনগণের অধিকাংশই ছিল শিক্ষাবঞ্চিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্য। বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ৯ শতাংশ। এমন শূন্য হাতে বঙ্গবন্ধু নেমে পড়েছিলেন সোনার বাংলা গড়তে। স্বপ্ন ছিল বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর। বলেছিলেন, ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ সেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’আজ পূর্ণতার পথে। ৫০ বছর আগের সে চিত্রকে পেছনে ফেলে বিশ্বে আজ সফল অর্থনৈতিক উদাহরণের নাম বাংলাদেশ। নানা সাফল্যের গল্পও করা হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঘিরে।

মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ২৯তম বৃহৎ অর্থনীতি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশও পেয়েছে। অথচ ১৯৭২ সালে এ অবস্থা ধারণার মধ্যেই ছিল না, যদিও সে অসম্ভবকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ ছিল ছয় দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩৮ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ স্বাধীনতার ৫০ বছরে তথা সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশের অর্থনীতি বড় হয়েছে প্রায় ৫৪ শতাংশ।

যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের অর্থনীতির এ অর্জনকে বিস্ময়কর বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সম্প্রতি তিনি একটি জাতীয় দৈনিক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ বা ’৭৩ সালে কল্পনাই করা যেত না ৫০ বছরে বাংলাদেশ কোথায় থাকবে। নানা ধরনের আশঙ্কাও করা হয়েছিল সে সময়। তবে সব ধরনের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে আজকের অবস্থানে এসেছে বাংলাদেশ। এখন সাফল্যের বিভিন্ন ধরনের উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশকে তুলনা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে কোনো ধরনের অবকাঠামো ছিল না। বড় কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও ছিল না। শিক্ষার হার ছিল অনেক কম। দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় শতভাগ। সেখানে থেকে ঘুরে দাঁড়ানো অবশ্যই অনেক চ্যালেঞ্জের। আর সেটা খুব ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছে বাংলাদেশ।

বহুজাতিক এ সংস্থাটির তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর প্রথম তিন বছর বাংলাদেশের জিডিপির আকার মোটামুটি দ্রুত বাড়ে। মূলত যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠন ও অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে বিনিয়োগ করায় এটি অর্জন সম্ভব হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার দাঁড়ায় ১৯ দশমিক ৪৪৮ বিলিয়ন ডলার। এরপর দুই বছর তা কমে ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে এর জন্য দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ১৯৭৮ সাল থেকে আবার জিডিপির আকার বাড়তে শুরু করে। ১৯৮১ সালে তা ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ১৯৮২ ও ’৮৩ সালে আবার জিডিপির আকার হ্রাস পায়। এর পর থেকে নিয়মিতই বাড়ছে জিডিপি। তবে গতি ছিল কিছুটা মন্থর। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০০০ সালে এর আকার বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। ২০০২ সালের পর থেকে জিডিপির আকার দ্রুত বাড়তে শুরু করে।

সে বছর এর পরিমাণ ছিল ৫৪ দশমিক ৭২৪ বিলিয়ন ডলার। ২০০৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১ দশমিক ৮১৯ বিলিয়ন ডলারে। ২০০৯ সালে জিডিপির আকার ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। আর মাত্র সাত বছরের মধ্যে তা দ্বিগুণের বেশি বাড়ে। ২০১৬ সালে জিডিপির আকার ২০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় আড়াইশ বিলিয়ন ডলারে।

২০১৮ তা আরও বেড়ে হয় ২৭৪ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১৯ সালে তা ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। ২০২০ সালে জিডিপির আকার আকার বেড়ে হয় ৩১১ বিলিয়ন ডলার। মূলত করোনার কারণে জিডিপির আকার বৃদ্ধির হারে কিছুটা ভাটা পড়ে। আর চলতি বছর বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৩৩৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৬৪ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের অর্জন ৭৫ দশমিক ৪। অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭ বা তারও কম। বাঙালি বীরের জাতি। মাত্র নয় মাসে আমরা আমাদের স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছি।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমাদের এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ অচিরেই একটি উন্নত-সমৃদ্ধ মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, ইনশাআল্লাহ। আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন হয়েছে। দ্য ইকোনমিস্টের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।এই বীরের জাতি এখন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, উন্নয়নশীল দেশের পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে। এ অর্জন বঙ্গবন্ধুরই ফেলে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ। যা কাঁধে তুলে নিয়েছেন তাঁরই কন্যা, সঙ্গে রয়েছে বাংলার জনগণ।

তাই তো স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর শুভক্ষণে এই অর্জন- এটি তো বঙ্গবন্ধুকে এ জাতির শ্রেষ্ঠ উপহার। এ জাতি এখানেই তৃপ্ত থাকবে না, থেমে থাকবে না। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে পূর্ণ উদ্যমে এগিয়ে যাবে।

আহসান আমীন, লেখক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক