ডা. মামুন আল মাহতাব: আবারও আলোচনায় কোভিড, আবারও কঠোর নিষেধাজ্ঞা। সিদ্ধান্তটা হঠাৎ হলেও অবাক নয়। গত ক’দিনে লাফিয়ে-লাফিয়ে যেভাবে বাড়ছিল কোভিড আর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল আমাদের ‘কোভিড উদাসীনতা’ এর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে, এমন একটা কিছু আসতে যাচ্ছে। কোভিড নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর নানা দেশে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

ব্রিটেন বা সুইডেন শুরুতে অগ্রাধিকার দিয়েছিল জীবিকায়। লকডাউনের বদলে হার্ড ইমিউনিটির পথে হাঁটতে গিয়ে বড় ধাক্কা খেতে হয়েছিল তাদের। জীবনকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে জার্মানি আর সাথে অনেক ইউরোপীয় দেশের কোভিড নিয়ন্ত্রণে আস্থা ছিল কঠিন লকডাউনে। প্রাথমিক সাফল্য আসলেও পরে তা ভেসে গিয়েছিল কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভে। অদ্ভুত পথে হেঁটেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রাজিল। ‘কোভিড কোন ব্যাপারই না’ টাইপ এপ্রোচ নিতে গিয়ে ধ্বসে গিয়ে বসে পড়েছে তারা।

সেই জায়গাটায় অদ্ভুত সফল আমাদের ‘জীবন আর জীবিকার’ নীতি। শুরুতেই নিয়ন্ত্রিত কঠোর নিষেধাজ্ঞা, আগে-ভাগে প্রণোদনা, যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা আর নরমে-গরমে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলায় উৎসাহিত করার মাধ্যমে আমরা একটা পর্যায়ে ঠেকিয়ে দিয়েছিলাম কোভিডের সেকেন্ড ওয়েভও, এমনকি কোভিডের নতুন রোগী শনাক্তের হার এই ক’দিন আগেও নেমে এসেছিল দেড় শতাংশের আশেপাশে। তারপর হঠাৎই সব পাল্টে গেল। খুলে গেল প্যান্ডোরার বাক্সটা। বাক্সের ঢাকনা কীভাবে খুলেছে তা নিয়ে অবশ্য খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন নেই।

গুগল কোভিড-১৯ কমিউনিটি মোবিলিটি রিপোর্ট অনুযায়ী, গত তের মাসের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ সবচাইতে বেশি বাইরে গিয়েছে এ বছরের ফেব্রুয়ারি আর মার্চে। দেশে-দেশে মানুষের জীবনযাপন আর চলাফেরার তথ্যগুলো গুগল সংগ্রহ করেছে তাদের বিভিন্ন প্রোডাক্ট ব্যবহারকারীদের ভৌগলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে।

গুগল কোভিড-১৯ কমিউনিটি মোবিলিটি রিপোর্ট অনুযায়ী, গত তের মাসের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ সবচাইতে বেশি বাইরে গিয়েছে এ বছরের ফেব্রুয়ারি আর মার্চে। দেশে-দেশে মানুষের জীবনযাপন আর চলাফেরার তথ্যগুলো গুগল সংগ্রহ করেছে তাদের বিভিন্ন প্রোডাক্ট ব্যবহারকারীদের ভৌগলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে।

রিটেইল অ্যান্ড রিক্রিয়েশন, সুপার মার্কেট অ্যান্ড ফার্মেসি, পার্ক, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, ওয়ার্কপ্লেস আর রেসিডেনসিয়াল-মানুষের কাটানো সময়কে এই ছয় ক্যাটাগরিতে ভাগ করে করোনা মহামারি শুরুর আগের কয়েক মাসের গড়কে ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে এই রিপোর্টে।

গুগল কোভিড-১৯ কমিউনিটি মোবিলিটি রিপোর্ট অনুযায়ী, এদেশের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ ঘরের ভেতরে ছিল গত বছর ৯ এপ্রিল আর সব বাধা ভেঙ্গে গিয়েছে এ বছরের ফেব্রুয়ারি আর মার্চে। বিশেষ করে বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে আর সুপার মার্কেটে ঘুরে বেরিয়েছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও ত্রিশ শতাংশ বেশি মানুষ। বাদ যায়নি পার্ক আর খেলার মাঠও।

সেখানে মানুষের উপস্থিতি ছিল এই সময়টাতে স্বাভাবিকের চেয়ে এগারো শতাংশ বেশি। সবচেয়ে বড় অঘটনটি ঘটেছে এ বছরের ১৯ মার্চ, যেদিন স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও ৪৬ শতাংশ বেশি মানুষ ঘরের বাইরে ঘুরে বেরিয়েছেন।

এই মুহূর্তে করোনা যে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাই-যাই করছে, সেটি নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এ জন্য দায়-দায়িত্ব যে আমার-আপনার মতো সবার, সেটাও বলাই বাহুল্য। করোনাকে আবারও নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে লাগামটা টানতে হবে এখনই। হয়েছেও তাই, ঘোষিত হয়েছে সাত দিনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা।

তবে লাগামটা টানতে গিয়ে গত বছরের সাফল্য আর ব্যর্থতার আলোকে আমাদের নিজস্ব যে ‘জীবন-জীবিকা মডেল’ সেখান থেকে সরে আসারও কোনো সুযোগ নেই। এবার যা করতে হবে তা হলো জীবনকে জীবিকার চেয়ে একটু হলেও এগিয়ে রাখতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সদ্যই কোভিড-১৯-এর বিস্তার রোধে যে বিধি নিষেধের তালিকাটি প্রকাশ করা হয়েছে তাতেও এই বিষয়টাই স্পষ্ট।

সামনে করোনার গতিবিধি বুঝে বাড়তে পারে কঠোর নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ, বাড়তে-কমতে পারে আরোপিত বিধি নিষেধও। তবে করোনাকে সপ্তাহখানেকে আগের জায়গাটায় ফিরিয়ে নিতে হলে এই বিধি নিষেধগুলো মেনে চলা আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। মনে রাখতে হবে আমরা কোনো পুলিশি রাষ্ট্র নই। কাজেই আমরা চীনের মতো করে কোভিডকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবো না। সেই জায়গায় আমাদের সবার সচেতনতা আর সহযোগিতাটাই মুখ্য।

পাশাপাশি আমাদের কোভিডের তৃতীয়, চতুর্থ কিংবা পঞ্চম ওয়েভের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই। গণমাধ্যম বলছে, একজন শীর্ষ কর্মকর্তা হতাশা ব্যক্ত করেছেন, সরকারি গুদামে যখন তিন শতাধিক আইসিইউ বেড আর হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা এবং আরও দেড় শতাধিক ভেন্টিলেটর পড়ে আছে, অন্যদিকে তখন আইসিইউ’র অভাবে হাসপাতালে-হাসপাতালে চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছেন মুমূর্ষু রোগীরা।

এদেশের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ ঘরের ভেতরে ছিল গত বছর ৯ এপ্রিল আর সব বাধা ভেঙ্গে গিয়েছে এ বছরের ফেব্রুয়ারি আর মার্চে। বিশেষ করে বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে আর সুপার মার্কেটে ঘুরে বেরিয়েছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও ত্রিশ শতাংশ বেশি মানুষ। বাদ যায়নি পার্ক আর খেলার মাঠও।

গত শীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় ওয়েভের ব্যাপারে সতর্কবার্তাটি দেওয়া মাত্রই সচেতন হয়ে উঠেছিল দেশের মানুষ। তাদের সচেতনতাতেই তখন ঠেকানো গিয়েছিল আজকের বিপর্যয়টিকে। অথচ তখন থেকেই আমরা সরকারি হাসপাতালগুলোয় কোভিড বেডের সংখ্যা কমে আসতে দেখেছি।
উদাসীনতা দেখেছি আমরা ভ্যাকসিন সক্ষমতা অর্জনের বেলাতেও। আজকে আমাদের কোভিশিল্ড প্রাপ্তির শতভাগতো বটেই, বরং তারচেয়েও বেশি কৃতিত্ব প্রাপ্য শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর। অন্য কারো ভূমিকা এখানে ন্যূনতম।

দেশে উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটই হোক কিংবা টেক-ট্রান্সফারের মাধ্যমে বাইরে উদ্ভাবিত কোভিড ভ্যাকসিনের দেশে উৎপাদন, এই দুই ক্ষেত্রেই আমাদের নিরুত্তাপ নিষ্ক্রিয়তা অমার্জনীয়। দেশে ভ্যাকসিনের ঘাটতি আছে কি নেই কিংবা কোভিড চিকিৎসার জন্য পুরো ঢাকা শহরটাকেই হাসপাতাল তৈরির প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে সাধারণকে অবহিত করায় আমাদের আগ্রহের ব্যাখ্যাটা অনেক আগ্রহী হয়েও আমি ব্যাখ্যা করতে পারিনি।

কোভিড সম্বন্ধে মানুষের ধারণা কম। মানব জাতির সম্বল বলতে গত একটি বছরের অভিজ্ঞতা। শুধু এক জায়গাতেই ব্যতিক্রম দেখি। বিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও যিনি কোভিডকে শিখে-বুঝে বশে আনায় তার পরাঙ্গমতার অনন্য স্বাক্ষর রেখে চলেছেন তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। এক তিনিই সামনে থেকে কোভিডকে মোকাবেলা করবেন আর বাকিরা নাকে তেল দিয়ে কুম্ভকর্ণের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, তা আমাদের কতদিন দেখতে হবে তা স্রষ্টাই ভালো জানেন!

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব

চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়