দেশ প্রতিক্ষণ, বরিশাল: বরিশালে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রোগের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে না আসায় ওয়ার্ডে জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। তাই চাপ সামলাতে হাসপাতাল কম্পাউন্ডে প্যান্ডেল তৈরি করে অস্থায়ী বেডে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।

ওয়ার্ডের বাইরে বৈদ্যুতিক পাখা না থাকায় গরমে নাভিশ্বাস উঠেছে চিকিৎসাধীন রোগীদের। হাসপাতালে পর্যাপ্ত আইভি স্যালাইন নেই। ফলে তা বাইরের দোকান থেকে কিনতে হচ্ছে রোগীর স্বজনদের। মঙ্গলবার দুপুরে হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ড ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

ব‌রিশাল সদরের জাগুয়া ইউ‌নিয়‌নের আব্দুর রব ডায়‌রিয়ায় আক্রান্ত হ‌য়ে সদর হাসপাতা‌লে ভ‌র্তি হ‌য়ে‌ছেন রোববার। বেড না পেয়ে চি‌কিৎসা নি‌চ্ছেন হাসপাতা‌লের মা‌ঠে। ভ‌্যান চালক আব্দুর র‌বের অভি‌যোগ, হাসপাতাল থেকে দেয়া হচ্ছে না স্যালাইন, কিনতে হচ্ছে বাইরে থেকে।

তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল দিয়া এক‌টা স‌্যালাইন দেছেল‌ শরী‌রে দেয়ার লইগ্গা। স‌্যালাইন শেষ হওয়ার পর নার্সগো ধা‌রে চাইছেলাম, হেরা কই‌ছে এহা‌নে নাই। কইলো ফা‌র্মেসি দিয়া কিন্না আনেন। ‘সরকা‌রি হাসপাতা‌লে যদি স‌্যালাইন না থা‌হে তয় মো‌গো মতো গরীব মাইনষে কেম‌নে চি‌কিৎসা নিমু। প‌রে হেই কথা মত দুইটা স‌্যালাইন কেনা লাগ‌ছে।’

আব্দুর রবসহ হাসপাতালে ভ‌র্তি অন্য ডায়রিয়া রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সুযোগে হাসপাতালের বাইরের ওষুধের দোকানগুলো বেশি দামে স্যালাইন বিক্রি করছে। ৯০ টাকার স্যালাইন কারও কাছে চাওয়া হচ্ছে ১২০ বা ১৩০ টাকা, কারও কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ২০০ টাকাও। স‌রেজ‌মি‌নে সোমবার সকা‌লে সদর হাসপাতা‌লের সাম‌নে দেখা গেল, ডায়রিয়া রোগীর স্বজনরা স্যালাইনের জন্য ভিড় করে আছেন ওষুধের দোকানগুলোতে।

জা‌কিয়া বেগম না‌মে এক রোগীর স্বজন‌ অভিযোগ করেন, ‘এম‌নেই কো‌নো সিট পাই নাই। হের উপর স‌্যালাইনডাও কেনা লা‌গে য‌দি তয় কি‌ চি‌কিৎসা দেয় বু‌ঝিনা। স‌্যালাই‌নের আসল দাম ৯০ টাহা, আর হেই স‌্যালাইন ফার্মেসি ওয়ালারা সি‌ন্ডি‌কেট কইরা ১৩০ টাহায় বে‌চে। এহা‌নের ডাক্তার নার্সরা একটা বা দু্ইটা দিয়াই কয় নাই শেষ স‌্যালাইন।’

হাসপাতা‌লের সামনের দি সেবা মে‌ডি‌ক্যাল হ‌ল নামের ওষুধের দোকানের কর্মচারি মো. বদরু‌দ্দোজার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেন স্যালাইনের দাম বেশি রাখা হচ্ছে। তিনি ব‌লেন, ‘হাজার মি‌লির ক‌লেরা স‌্যালাইন রেট ৯০ টাকা ক‌রেই। ত‌বে প্রোডাকশন কম থাকায় কোম্পানি অনেক বে‌শি দা‌মে বি‌ক্রি ক‌রে‌ছে‌। তাই আমা‌দেরও বেশি দামে বি‌ক্রি কর‌তে হ‌য়ে‌ছে।’

হাজরা মে‌ডি‌ক্যাল হ‌লের মো. শুভ ব‌লেন, ‘৫০০ মিলির ক‌লেরা স‌্যালাই‌নের দাম ৭০ টাকা আর হাজার মিলির কোম্পানি রেট ৯০ টাকা। অনেকে বে‌শি দাম রে‌খে‌ছে। কিন্তু আমরা তা ক‌রি‌নি।’ নগরীর অন্য এলাকার ওষুধের দোকানে গিয়ে জানা গেল, স্যালাইনের দাম বাড়েনি। আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে।

নগরীর বিএম ক‌লেজ এলাকার মা মে‌ডি‌ক্যাল হ‌লের মা‌লিক মো. কা‌দের ব‌লেন, ‘ক‌লেরা স‌্যালাইনের দাম বা‌ড়ে‌নি। যারা বে‌শি দাম নি‌চ্ছে তারা অবৈধভাবে তা নি‌চ্ছে।’

এদিকে, রোগীদের স্যালাইন বেশি কিনতে হচ্ছে এমন অভিযোগের বিষয়ে জেনা‌রেল হাসপাতা‌লের আবা‌সিক চিকিৎসা কর্মকর্তা মলয় কৃষ্ণ বড়াল ব‌লেন, ‘স্বাভা‌বিকভা‌বে একজন রোগী‌কে তিন থে‌কে চারটি স‌্যালাইন আমরা দি‌য়ে থা‌কি। এর বেশি স‌্যালাইন লাগলে তা‌দের কিন‌তে হয় বাই‌রে থে‌কে। এম‌নি‌তে স্যালাইনের কোনো সংকট নেই আমা‌দের।’

ওষুধের দোকানের সঙ্গে যোগসাজশ করে স্যলাইনের সংকট দেখিয়ে নার্সরা রোগীদের তা কিনতে বাধ্য করছে কি না এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি এড়িয়ে যান। বরিশাল বিভাগে কয়েকদিন ধরেই বাড়ছে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা। এতে খোদ স্বাস্থ্য বিভাগ উদ্বিগ্ন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, বরিশালে এর আগে এমন ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা যায়নি।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বাসুদেব কুমার দাস বলেন, ‘হঠাৎ করে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করেছি আমরা। শহরের মানুষ তেমন আক্রান্ত না হলেও, বেশি আক্রান্ত হচ্ছে উপকূল ও গ্রামাঞ্চলের মানুষ।’

তিনি জানান, অতিরিক্ত গরমে স্বস্তি পেতে মানুষ পান্তা কিংবা শরবত খাচ্ছে বেশি। এসব তৈরিতে দূষিত পানি ব্যবহারের কারণেই ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে বলে তার মত।

বাসুদেব কুমার দাস জানিয়েছিলেন, বরিশাল বিভাগে ১৮ দিনে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ২৯ হাজার ১১৪। সব থেকে বেশি আক্রান্ত দ্বীপ জেলা ভোলায়। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ৭ হাজার ৪২১। পটুয়াখালীতে আক্রান্ত ৬ হাজার ৭৩৭, পিরোজপুরে ৩ হাজার ৭৫০, বরগুনায় ৪ হাজার ৩৫৩ এবং ঝালকাঠিতে আক্রান্ত ২ হাজার ৯৯৮ জন।

জেনা‌রেল হাসপাতা‌লের তথ্য অনুযায়ী সেখানে গত ২৪ ঘন্টায় ৯৪ জন ডায়া‌রিয়ায় আক্রান্ত রোগী ভ‌র্তি হন। জায়গা সল্পতার কার‌ণে অনেককে মা‌ঠে, ভ‌্যানে, গাছ তলায় বা ড্রেনের পা‌শে চি‌কিৎসা নি‌তে দেখা গে‌ছে।