ঋণ খেলাপি হয়েও সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক!
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ব্যাংকঋণ খেলাপি হয়েও বিমা কোম্পানির পরিচালক হয়েছেন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড । তিন হলেন শেখ মোহাম্মদ ডানিয়াল। তিনি শেয়ারবাজারে সম্প্রতি তালিকাভুক্ত হওয়া সোনালী লাইফ ইন্সুরেন্সের পরিচালক। শেখ মোহাম্মদ ডানিয়াল চলতি বছরের শুরুর দিকে খেলাপি হয়েছেন পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড খাতুনগঞ্জ শাখায়।
তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মিরেজ এগ্রো কমপ্লেক্সের নামে নেয়া কৃষিঋণ পরিশোধ না করায় খেলাপি হয়ে পড়ে। সুদাসলে এ ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩৮ কোটি টাকায়। আর এ পাওনা আদায়ে গত ২৯ আগস্ট পদ্মা ব্যাংক চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে।
পদ্মা ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে পদ্মা ব্যাংক লিমিটেডের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে মিরেজ এগ্রো কমপ্লেক্স নামক একটি প্রতিষ্ঠানের নামে কৃষিঋণ নেন শেখ মোহাম্মদ ডানিয়াল। তিনি মিরেজ গ্রুপের একজন পরিচালক। প্রথম দিকে কয়েকটি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করলেও পরে তা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এরপর একবার ঋণটি পুনঃতফসিল করেছিলেন। এরপর আবারও খেলাপি হয়ে পড়েন। আবারও পুনঃতফসিলের আবেদন করলে ব্যাংকে আবেদন গ্রহণ করেনি।
শেখ ডানিয়েলের প্রতিষ্ঠান চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড খাতুনগঞ্জ শাখায় খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। যদিও এর আগে ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর এনআই অ্যাক্ট চেক প্রত্যাখানের জন্য মামলা করা হয়েছিল। আর গত ২৯ আগস্ট খেলাপি ঋণ আদায়ে চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে ব্যাংক করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকটির পাওনা ৩৭ কোটি ৭৬ লাখ ৮৮ হাজার ৮৩২ টাকা।
এ পাওনা আদায়ে বেশ কয়েকবার তাগাদা দেওয়া হলেও শেখ মোহাম্মদ ডানিয়াল খেলাপি পাওনা পরিশোধে আগ্রহ দেখাননি। এমনকি পাওনা আদায়ে ঋণের বিপরীতে থুলিশী মৌজায় দোতলা ভবনসহ ৩৩ শতাংশ বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তোলা হলেও আগ্রহী ক্রেতা না থাকায় বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি হয়নি।
এদিকে গত ৩০ জুন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় জীবন বিমা খাতের কোম্পানি সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড। এ বিমা কোম্পানির একজন উদ্যোক্তা পরিচালক হলেন শেখ মোহাম্মদ ডানিয়াল। বিমা খাতের এ কোম্পানিটির ১৮ লাখ শেয়ার ধারণ করছেন খেলাপি ব্যবসায়ী ডানিয়াল, যিনি আবার সাধারণ বিমা খাতের আরেক কোম্পানি রূপালী ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডেরও পরিচালক। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান।
শুধু শেখ ডানিয়েল নন, এ ঋণের জামিনদার হিসেবে আছেন তার স্ত্রী তাসনিয়া কামরুন আনিকা। যিনি রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ও সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের উদ্যোক্তা পরিচালক। এরই মধ্যে রূপালী ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের নিয়োগ ও বেতন কমিটির (এনআরসি) চেয়ারম্যান এবং সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া এর বন্ধকদাতা হিসেবে আছেন ডানিয়ালের বাবা আবদুল মতিন। যিনি কর্ণফুলী ইপিজেডে অবস্থিত ফাইনেস অ্যাপারেল লিমিটেডের চেয়ারম্যান।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেন, কোম্পানি আইন ১৯৯২ (২০১৮ সালে সংশোধিত) ১৭ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠন কিংবা বিমা কোম্পানির পরিচালক যে ব্যাংকে ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়েছেন, সেই ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি পরিচালককে দুই মাসের মধ্যে ঋণ পরিশোধের জন্য নোটিস প্রদান করে। আর এ সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে পরিচালক পদ শূন্য হয়।
বিষয়টি নিয়ে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের একাধিক আইন কর্মকর্তা বলেন, খেলাপি হলে কোনো বিমা কোম্পানির পরিচালক পদে থাকা যাবে না। আর এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ। তবে খেলাপি হওয়ার বিষয়ে ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করলে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে। এমনকি খেলাপি ঋণের জামিনদারও যদি কোনো বিমা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হন, তিনিও পরিচালক পদ হারাবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আইন অনুসারে কোনো খেলাপি ঋণের গ্রাহক বিমা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে থাকতে পারবেন না। হয়তো শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত হওয়ার সময় সিআইবি রেগুলার ছিল। বিষয়টি আমাদের দেখতে হবে। যদি খেলাপি হন তাহলে পরিচালক পদ ছাড়তে হবে। আমাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিষয়টি দেখবে।’
পদ্মা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমাস ব্যাংক) থেকে শেখ মোহাম্মদ ডানিয়াল ২০১৫ সালের কৃষি খাতে ঋণ সুবিধা নেন। যদিও তখনকার একজন পরিচালক এ ঋণের ব্যাপারের আত্মীয়তার কারণে সহযোগিতা করেছিলেন। এখন তিনি পরিচালক হিসেবে নেই। আর ডানিয়ালও ব্যাংকের পাওনা নিয়মিতভাবে পরিশোধ করেনি।
আমরা পাওনা আদায়ে একাধিকবার তাগাদা দিলেও তিনি পাওনা পরিশোধে উদ্যোগ নেননি। এমনকি তার ব্যাংক হিসাবের প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় চেক প্রত্যাখ্যান করাও হয়েছিল। এ কারণে ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর চেক প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।
পরে তিনি সিআইবি হাইকোর্ট থেকে স্টে-অর্ডার নিয়েছিলেন। তবে স্টের মেয়াদ শেষ হওয়ায় গত ২৯ আগস্ট খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছি। আসলে তিনি ইচ্ছাকৃত খেলাপি। এমনকি ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না।’