স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বীমা খাতের পরিচালকদের গত ১ মাস ধরে শেয়ার বিক্রির হিড়িক পড়ছে। ফলে ধারাবাহিক কমছে বীমা খাতের শেয়ারের দর। গত এক মাসে বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে ঢাকা ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে। এমন উদ্যোক্তা পরিচালকও আছেন, যিনি তার হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। এমনও আছেন, যিনি হাতে থাকা বেশির ভাগ শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

সব মিলিয়ে চলতি বছর বিমা খাতের উদ্যোক্তা পরিচালকরা মোট ১ কোটি ১৫ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫০টি শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে সিংহভাগ এরই মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। আর বাকিগুলো বিক্রি করার ঘোষণা এখনও বলবৎ আছে। উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি করতে হলে আগাম ঘোষণা দিতে হয়।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা কোম্পানির সংখ্যা ৫১টি। এর মধ্যে পাঁচটির মোট শেয়ারের ৬০ শতাংশের বেশি ধারণ করে আছেন উদ্যোক্তা পরিচালকরা। এর মধ্যে সম্প্রতি একটি কোম্পানির ৬০ লাখের বেশি শেয়ার কিনে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হিস্যা ৬০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। এটি হলো স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স। গত জুন থেকে এই খাতে যে দর সংশোধন শুরু হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে, এই কোম্পানির শেয়ার দরে পতন হয়নি, উল্টো বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।

বিমা খাতে গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে ব্যাপক হারে। এমনও দেখা গেছে, মোট লেনদেনের ৩০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে এই একটি খাতেই। বিমা খাতে এক দিনে ৯০০ কোটি টাকারও বেশি লেনদেনের রেকর্ডও আছে। এখন কোনো কোনো দিন ২০০ কোটি টাকার নিচে, কখনও কখনও দেড় শ কোটি টাকারও নিচে হয় লেনদেন। আর এক দিন দাম বাড়লে চার দিন কমে, এভাবে ক্রমাগত কমছে শেয়ার দর।

কোম্পানিগুলোর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন ঘোষণার কারণে শেয়ার দর অনেক বেড়ে যায়। আর বেড়ে যাওয়া শেয়ারগুলো বিক্রি করে বেশি মুনাফা তুলছে অনেক উদ্যোক্তা/ পরিচালক। সব শেয়ার বিক্রি করে দিবেন, এমন বিমা কোম্পানিরও রয়েছেন কয়েকজন পরিচালক।

মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্সের তিন পরিচালক হাতের হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। গত ১৯ আগস্ট কোম্পানিটির পরিচালক মোহাম্মদ আলী আজগর তার কাছে থাকা কোম্পানির ২ লাখ ৮৭ হাজার ৩০২টি শেয়ারের সব বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দেন।

আরেক উদ্যোক্তা সৈয়দ নূর আলম তার কাছে থাকা ১ লাখ ২৩ হাজার ২০০টি শেয়ারের সব বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দেন। আরেক পরিচালক মাহতাবুদ্দিন চৌধুরীও তার কাছে থাকা কোম্পানির ৮ লাখ ৯৮ হাজার ৫০৯টি শেয়ারের সব বিক্রি করার ঘোষণা দেন।

তিনজনের শেয়ার সংখ্যা কোম্পানির মোট শেয়ারের ৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। তাদের কারও হাতে ২ শতাংশ শেয়ার না থাকার পরেও তারা উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন এতদিন। এই শেয়ারগুলো বিক্রি হলে কোম্পানির মোট শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হিস্যা কমে যাবে ৩০ শতাংশের নিচে। কোম্পানির মোট শেয়ারের ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ আছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে। সেটি কমে হবে ২৮ দশমিক ৭৯ শতাংশে।

সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের দুই উদ্যোক্তা এম এ মালেক তার হাতে থাকা ২১ হাজার ৫৭৫টি শেয়ারের সবগুলো আর জয়নাল আবেদন চৌধুরীর হাতে থাকা ১৩ হাজার শেয়ার বিক্রি করার ঘোষণা দিয়েছেন। কমপক্ষে ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের যে নির্দেশনা এক দশক আগে দেয়া হয়েছিল, সেই নির্দেশনা অনুযায়ী, তাদের কারও পরিচালক থাকার কথা ছিল না এই নগণ্যসংখ্যক শেয়ার নিয়ে।

কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা ৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৮২৩টি। কমপক্ষে ২ শতাংশ ধারণ করতে হলে একেকজনের হাতে থাকতে হতো ১০ লাখ ৬২ হাজার ৮৯৬টি শেয়ার।

ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন তার হাতে থাকা ১৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮১১টি শেয়ারের সবগুলো বিক্রির ঘোষণা দেন গত ১০ আগস্ট। গত ১৯ আগস্ট জানান, তিনি সবগুলো শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। মোয়াজ্জেম হোসেনের হাতে কোম্পানির মোট শেয়ারের ২ শতাংশ ছিল। এগুলো বিক্রি করে দেয়ায় কোম্পানিতে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হিস্যা ৪১ দশমিক ১৩ শতাংশ থেমে কমে হবে ৩৯ দশমিক ১৩ শতাংশে।

সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক রওশন আরা কোম্পানিটিতে আর থাকতে চাইছেন না। তার কাছে থাকা কোম্পানির ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮১০টি শেয়ারের সবগুলোই বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। রোববার দেয়া এক ঘোষণায় আগামী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে শেয়ার বিক্রি করবেন বলে জানানো হয়েছে।

কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে আছে মোট শেয়ারের ৩১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আইন অনুযায়ী কোম্পানিটির শেয়ারবাজার থেকে আরও ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ শেয়ার কেনার কথা। রওশন আরা সরে দাঁড়ালে কোম্পানিতে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ারের হিস্যা কমে দাঁড়াবে ৩১ দশমিক ৪৫ শতাংশে।

এই ঘোষণা আসার পর রওশন এতদিন উদ্যোক্তা পরিচালকের পদে কীভাবে ছিলেন, সেটি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা ১০ কোটি ৯৬ লাখ ৯৮ হাজার ৬৩৩টি। উদ্যোক্তা পরিচালক হতে হলে ২ শতাংশ হিসেবে কমপক্ষে ২১ লাখ ৯৩ হাজার ৯৭২টি শেয়ার থাকতে হতো তার। কিন্তু এর মাত্র দশমিক ১৩ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেই তিনি এই পদে ছিলেন। রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের করপোরেট উদ্যোক্তা মিনহার ফিশারিজের হাতে থাকা ২২ লাখ শেয়ারের সবগুলো ব্লক মার্কেটে বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দেন গত ২৯ এপ্রিল।

ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক আবদুল মান্নান ও তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান তাদের মালিকানাধীন কোম্পানি পেনিনসুলা গার্মেন্টস, সানপ্যাক ইন্ডাস্ট্রিজ ও পাইওনিয়ার ড্রেস লিমিটেডের হাতে থাকা ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। প্রথমে ঘোষণা আসে ৬ লাখ ৫৯ হাজার ১২০টি শেয়ার বিক্রির। এই শেয়ার বিক্রি শেষ না হতেই আসে এর চেয়ে চার গুণ বেশি শেয়ার বিক্রির ঘোষণার।

গত ৩১ আগস্ট ষোষণা আসে, পেনিনসুলার হাতে থাকা ৫ লাখ ২৮ হাজার ৬২২টি শেয়ারের মধ্যে ৩ লাখ ১০ হাজার ৭২২টি, সানপ্যাকের হাতে থাকা ৫ লাখ ২৮ হাজার ৬৩৩টি শেয়ারের মধ্যে ৩ লাখ ১০ হাজার ৭৩৩টি আর পাইওনিয়ার ড্রেসের হাতে থাকা ৪ লাখ ১৩ হাজার ৯৮৫টি শেয়ারের মধ্যে ৩৭ হাজার ৬৩৫টি শেয়ার বিক্রির ঘোষণা এসেছে।

এই পরিমাণ শেয়ার কোম্পানির মোট শেয়ারের ১ দশমিক ৫২ শতাংশের কিছু বেশি। আর এগুলো বিক্রি হলে কোম্পানিতে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ারের হিস্যা ৫৪ দশমিক ১৬ শতাংশ থেকে কমে হবে ৪৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এই শেয়ার বিক্রি শেষ হতে না হতেই মান্নান ও তার স্ত্রী আরও বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন ৩০ সেপ্টেম্বর।

এদিন মান্নান জানান, তার হাতে থাকা ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ৫৬৭টি শেয়ারের মধ্যে তিনি বিক্রি করে দেবেন ১৮ লাখ ৭৫ হাজার শেয়ার। তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান তার হাতে থাকা ১৪ লাখ ৩৭ হাজার ৯টি শেয়ারের মধ্যে বিক্রি করে দেবেন ৫ লাখ ৭০ হাজার শেয়ার। একই দিন করপোরেট উদ্যোক্তা সানমান সোয়েটার তার হাতে থাকা ১২ লাখ ৪৩ হাজার ৯৪৯টি শেয়ারের মধ্যে বিক্রি করে দেবে ৩ লাখ ৮০ হাজার শেয়ার।

অর্থাৎ এক দিনে বিক্রির ঘোষণা আসে ২৮ লাখ ২৫ হাজার শেয়ার বিক্রির। এটি কোম্পানির মোট শেয়ারের ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের মোট ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে মালিকপক্ষ। এতে তাদের হিস্যা ৫৪ দশমিক ১৬ শতাংশ থেকে কমে হবে ৪৬ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।

গ্রিনডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালক মোজাম্মেল হক ও খুরশিদা চৌধুরী গত ৩ আগস্ট বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে মোজাম্মেল বিক্রি করবেন ৬ লাখ ৯ হাজার ৮৭৮টি ও আর খুরশিদা চৌধুরী বিক্রি করবেন ৫৭ হাজার ৪৬৯টি শেয়ার। কোম্পানির মোট শেয়ারের ৩৫ দশমিক ৩২ শতাংশ শেয়ার আছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে। এই শেয়ার বিক্রি হলে কোম্পানিতে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হিস্যা কমে যাবে শূন্য দশমিক ৬৬ শতাংশের কিছুটা বেশি।

মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দুজন উদ্যোক্তা পরিচালক এক দিনে তাদের হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ৩০ সেপ্টেম্বর দেয়া ঘোষণায় পরিচালক জামালউদ্দিন জানান, তিনি তার হাতে থাকা ৭১ হাজার ৫১২টি আর যোবায়দা ইসলাম তার হাতে থাকা ৫৯ হাজার ৮১৪টি শেয়ার বিক্রি করে দেবেন।

এই দুজনের হাতে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের শূন্য দশমিক ৩৯ শতাংশ শেয়ার ছিল। তারা বিক্রি করে দিলে কোম্পানিটিতে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার কমে হবে ৩০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশের মতো। এত কমসংখ্যক শেয়ার নিয়ে দুজন কীভাবে উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন, সেই প্রশ্নও আছে।

ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স ২৮ জুলাই কোম্পানিটির উদ্যোক্তা আজিজ আল মাহমুদ তার কাছে থাকা কোম্পানির ১৮ লাখ ১৭ হাজার ১২০টি শেয়ারের মধ্যে ৮ লাখ ১০ হাজার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই শেয়ার কোম্পানির মোট শেয়ারের ২ শতাংশের কিছুটা বেশি। বর্তমানে কোম্পানিতে উদ্যোক্তা পরিচালকরা সম্মিলিতভাবে ধারণ করে আছেন ৩৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ শেয়ার। একজন বিক্রি করে দিলেই তা কমে হবে ৩২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ।

সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মোট শেয়ারের ৩৮ শতাংশ শেয়ার আছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে। কোম্পানির উদ্যোক্তা মোহাম্মদ শফিক গত ২৬ সেপ্টেম্বর তার কাছে থাকা কোম্পানির ১ লাখ ৫২ হাজার ৯১৭টি শেয়ারের মধ্যে ১ লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘোষণার পর শফিক কীভাবে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক আছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কারণ, ২ শতাংশ শেয়ার তো দূরের কথা, তিনি ১ শতাংশ শেয়ারেরই মালিক নন। মোট শেয়ারের কেবল শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশের মতো মালিকানা নিয়ে তিনি পরিচালক আছেন, যা এখন আরও কমে যাবে।

কোম্পানিটির মোট শেয়ার ৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৮২৩টি। এর মধ্যে ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করে উদ্যোক্তা পরিচালক হতে হলে থাকতে হবে ১০ লাখ ৬২ হাজার ৮৯৬টি। এত কম শেয়ার হাতে থাকার পরেও তিনি কীভাবে উদ্যোক্তা পরিচালক থাকেন, তা নিয়েও আছে প্রশ্ন। একই কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক জয়নাল আবেদিন চৌধুরী গত ১২ সেপ্টেম্বর জানিয়েছেন, তিনি তার হাতে থাকা ১০ লাখ ৭৭ হাজার ৬৮৭টি শেয়ারের মধ্যে ১৩ হাজার শেয়ার বিক্রি করবেন।

অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান গত ৬ মে জানান, তিনি তার হাতে থাকা কোম্পানিটির ৭ লাখ ৫৬ হাজার ১০৭টি শেয়ারের মধ্যে দেড় লাখ বিক্রি করে দেবেন। পরে ৫ জুন তিনি জানান, সব শেয়ার বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আরেক উদ্যোক্তা পরিচালক মাহমুদুল হক একই সময়ে তার হাতে থাকা ১০ লাখ ৮০ হাজার শেয়ারের মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন ৩০ হাজার শেয়ার।

বিএনআইসিএল গত ৫ সেপ্টেম্বর কোম্পানির উদ্যোক্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া তার হাতে থাকা কোম্পানিটির ১২ লাখ শেয়ারের মধ্যে ৩ লাখ ১৪ হাজার ১৭৫টি বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ১৯ আগস্ট আরেক উদ্যোক্তা এম এফ কামাল তার হাতে থাকা ১২ লাখ শেয়ারের মধ্যে ৩ লাখ ১৪ হাজার ১৭৫টি বিক্রির ঘোষণা দেন।

এই কোম্পানির মোট শেয়ারের ৬০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ বর্তমানে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে আছে। এই দুই পরিচালক বিক্রি করবেন মোট শেয়ারের শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশের মতো। তারা শেয়ার বিক্রি করলে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হিস্যা ৬০ শতাংশের নিচে নেমে আসবে।

পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালক নাসিরুল্লাহ তার হাতে থাকা ২ লাখ ৩১ হাজার ৩৩২টি শেয়ারের মধ্যে ২০ হাজার শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন গত ১৪ সেপ্টেম্বর।

পূরবী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিটির পরিচালক খালিদ হোসেন তার হাতে থাকা ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭৬টি শেয়ারের মধ্যে ১ লাখ শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন গত ৭ সেপ্টেম্বর। রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পরিচালক শাওন আহমেদ তার হাতে থাকা ৩৯ লাখ ১৫ হাজার ৮১৬টি শেয়ারের মধ্যে ৫০ হাজার শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। এ ঘোষণা গত ১৬ মে। পরে নিশ্চিত করা হয়, সেগুলো বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।

চলতি বছরের শুরুতে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর পক্ষ থেকে ২০১০ সালের একটি চিঠি নতুন করে সব কোম্পানির কাছে পাঠানো হয়। তখনই শুরু হয় হইচই। বিমা কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের আইন বাস্তবায়নে শেয়ার কিনতে হবে, এমন খবরে হুহু করে বাড়তে থাকে শেয়ারের দর। কিন্তু চলতি বছর দাম বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে ১ কোটি ১৫ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫০টি শেয়ার বিক্রির ঘোষণা এসেছে।

উদ্যোক্তা পরিচালকের শেয়ার ৬০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে, ১১ বছর আগে করা এমন একটি বিধান বারবার প্রচারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত বছরের জুলাই থেকে বিমা খাতের শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে বাড়লেও ঘটছে উল্টো ঘটনা।  বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ একাধিকবার সেই বিধানের বিষয়টি উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। জানানো হয়েছে, বাজার থেকে শেয়ার কিনতে কোম্পানিকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এমনও বলা হয়েছে, একাধিক উদ্যোক্তা-পরিচালককে শেয়ার বিক্রি করতে দেয়া হয়নি।

বিমার উদ্যোক্তা-পরিচালকদেরকে কোম্পানির শেয়ারের কমপক্ষে ৬০ শতাংশ ধারণে ১০ বছর আগের একটি সিদান্ত নতুন করে সামনে এনে গত জানুয়ারিতে চিঠি দেয় বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। এরপর বিমা খাতের শেয়ারদর বাড়ে ব্যাপক হারে। গত ২০ জুনও আইডিআরএর চেয়ারম্যান এম মোশাররফ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।

সেদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময়ে তিনি বলেন, ‘তাদের (উদ্যোক্তা-পরিচালকরা) পুঁজিবাজার থেকে শেয়ার কিনতে হবে। এ জন্য হঠাৎ করে শেয়ার কেনার ক্ষেত্রেও জটিলতা আছে। তবে যেহেতু এটি আইনগত বিষয়, তাই জটিলতা থাকলেও আইগনত বিষয়টিকেই আমরা গুরুত্ব দেব।’ কিন্তু আইডিআরএ কী উদ্যোগ নিয়েছে সেটি স্পষ্ট নয়। বরং এখন বলা হচ্ছে, করোনা মহামারিতে কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক কার্যক্রম ভালো না হওয়ায় এমন সিদ্ধান্তে কিছুটা শিথিলতা দেখানো হচ্ছে।

সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র এস এম শাকিল আক্তার বলেন, `আইনের বিষয়টি সব কোম্পানিকেই জানানো আছে। তবে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড, করোনা মহামরি-পরবর্তী অবস্থায় বিষয়টি শিথিল অবস্থায় আছে। তবে আইনে যেহেতু আছে অবশ্যই তা বাস্তবায়ন করতে হবে।’

তবে করোনায় কোম্পানির ব্যবসা খারাপ হয়েছে এমন নয়। বরং চলতি বছর সিংহভাগ বিমা কোম্পানির আয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে দেখা যাচ্ছে। আর কোম্পানির ব্যবসা বাড়া বা কমার সঙ্গে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার ধারণের কী সম্পর্ক, সেটি নিয়েও আছে প্রশ্ন।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, ‘আইন থাকলে তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করা উচিত। সময় দেয়া যায়, কিন্তু সেই সময়েরও নির্দিষ্ট সময় থাকা উচিত।’ ‘আইডিআরএর সে সময় চিঠি দেয়ার পর প্রায় সব বিমা কোম্পানির শেয়ার দর ঢালাওভাবে বেড়েছে। অনেক বিমা কোম্পানির শেয়ার দর অতিমূল্যায়িত হয়েছে। মুনাফার আশায় বিনিয়োগকারীরা এই খাতে একচেটিয়ে বিনিয়োগ করেছেন।

এখন মূল্য সংশোধন হচ্ছে সত্য, কিন্তু বেশি দরে যারা শেয়ার কিনেছেন তারা এখন লোকসানে। এই দায়িত্ব কে নেবে? কোম্পানিগুলোকে শেয়ার কেনার জন্য অনেক সময় দেয়া হয়েছে, এখন নতুন করে শিথিলতার বিষয়টি কতটা যৌক্তিক, সেটিও বিবেচনা করা উচিত।’