দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: সরকারি ১৮টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা এখন প্রায় সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে তা সঠিক সময়ে পরিশোধ করেনি। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণই ৬৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত অনেক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং জবাবদিহির অভাব রয়েছে। এসব জনগণের করের টাকা দিয়ে পরিশোধ করতে হচ্ছে। দরকার সংস্কার। প্রয়োজনে পুঁজিবাজারে এগুলোর শেয়ার ছাড়তে হবে, ব্যক্তিমালিকানা খাতে দিতে হবে। তা না হলে সরকারের দায় আরও বাড়বে।

সরকার বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, আধাস্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, পাবলিক সেক্টর করপোরেশন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোকে উন্নয়ন প্রকল্প ও অনুন্নয়নমূলক কাজে অর্থায়ন করে থাকে। ঋণ হিসেবে দেওয়া ডিএসএল হলো সরকারের সেই পাওনা অর্থ। উন্নয়ন প্রকল্প ও অনুন্নয়নমূলক কাজের অর্থের উৎস দুটি বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে থেকে প্রাপ্ত প্রকল্প সহায়তা। উভয় ক্ষেত্রেই সরকার চুক্তির মাধ্যমে ঋণস্বরূপ এ অর্থ ওই সংস্থাগুলোকে দিয়ে থাকে।

ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চুক্তির শর্ত মতে পরিশোধের সময় অনুযায়ী কিস্তিভিত্তিক সুদসহ অথবা সুদ ব্যতীত এ অর্থ সরকারকে ফেরত দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বলা বাহুল্য, এসব শর্ত ও ঋণ বেশিরভাগ কোম্পানি পরিশোধ করে না। ফলে সরকারের পাওনা বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত এসব সংস্থা, আধাস্বায়ত্তশাসিত, স্থানীয় সরকার সংস্থার কাছে সরকারের বৈদেশিক ও স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সংকটের কারণে সরকার এসব ঋণ বিভিন্নভাবে নিজেই পরিশোধ করে থাকে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের গত ফেব্রুয়ারি শেষে এ ধরনের ১৮টি সরকারি সংস্থার কাছে ব্যাংকগুলোর বকেয়া পাওনার স্থিতি ছিল ৩৩ হাজার ৪৫১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠানের কিছু ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এর পরিমাণ ৬৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

গত বছরের তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঞ্জীভূত ব্যাংকঋণ ও খেলাপি ঋণ কমেছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি শেষে ১৮টি প্রতিষ্ঠানের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৯ হাজার ৩৪২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ৯টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। সে হিসাবে ১৩ মাসের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঞ্জীভূত ঋণ কমেছে পাঁচ হাজার ৮৯১ কোটি ৫১ লাখ টাকা এবং খেলাপি ঋণ কমেছে ১৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ বছর দেনার শীর্ষে রয়েছে ‘বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন’ (বিএসএফআইসি)। প্রতিষ্ঠানটির পুঞ্জীভূত ব্যাংকঋণ বাড়ছেই। গত ২০২০ সালের জানুয়ারি শেষে সংস্থাটির ব্যাংকঋণের পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৪৯১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। চলতি বছর ফেব্রুয়ারি শেষে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৯৮১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।

‘বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড’-এর (বিপিডিবি) দেনার পরিমাণ কমেছে। গত বছর বিপিডিবির ব্যাংকঋণের পরিমাণ ছিল সাত হাজার ৬৯১ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এক বছরে এটি কমে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৫৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

বর্তমানে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও দেনার দায়ে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তবে গত এক বছরে সংস্থাটির পুঞ্জীভূত ব্যাংকঋণ কমেছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি শেষে বিপিসির ব্যাংকঋণের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৩৪৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে এটি কমে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৭৮৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) দেনার পরিমাণ তিন হাজার ৫১৫ কোটি ৭ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ৪ হাজার ১০৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা)। বিএডিসির দেনার পরিমাণ ৩ হাজার ৪০২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ৩ হাজার ১৩৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা)। বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) দেনার পরিমাণ ৯৭১ কোটি ২৩ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ৯৩৫ কোটি ৭ লাখ টাকা)। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ব্যাংকঋণের পরিমাণ ৯৭০ কোটি টাকা (গত বছর ছিল এক হাজার ১৪৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা)।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিডব্লিউডিবি) দেনার পরিমাণ ৫৬৭ কোটি ৩ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ৬৯৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা)। পেট্রোবাংলার ব্যাংকঋণ ৩৩৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা (গত বছর ছিল দুই হাজার ২০৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা)। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দেনার পরিমাণ ২৬৭ কোটি ২ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ৫৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা)। বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থার (বিএসইসি) দেনার পরিমাণ ১১৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা (গত বছর ছিল এক হাজার ৪১১ কোটি ৭ লাখ টাকা)।

এ ছাড়া বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) দেনার পরিমাণ ৯৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা (গত বছরেও একই ছিল)। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) দেনার পরিমাণ ৯৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ১১৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা)। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের (বিটিএমসি) দেনার পরিমাণ ২৫ কোটি ২ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ২০ কোটি ৬২ লাখ টাকা)।

বাংলাদেশ টি বোর্ডের (বিটিবি) দেনার পরিমাণ ১০ কোটি ৫২ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ১০৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা) এবং বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) দেনার পরিমাণ দুই কোটি এক লাখ টাকা।

এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মন্তব্য করতে চাননি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানান, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি কমানো গেলে সমস্যার সমাধান হবে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নজর দিতে হবে। সুত্র: দৈনিক আমাদের সময়