আবদুর রহমান ও তৌফিক ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে গুজব রটিয়ে ফায়দা হাসিল স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কোনো কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আগাম ফাঁস করাকে সাধারণত গুজব বলা হয়। আর অধিকাংশ সময় রটে যাওয়া গুজব সত্য হতে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি তিন কোম্পানি ডিভিডেন্ড ও ২ কোম্পানির প্রথম প্রাান্তিক যা গুজব রটছে তাই কোম্পানির পক্ষ প্রকাশিত হয়।

এদিকে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এ ব্যাপারে সচেতন হলেও মুনাফার আশায় গুজবনির্ভর হয়ে পড়েন খুব সহজে। আর সে সুযোগে একটি মহল কোনো কোম্পানির শেয়ার দর বাড়া কিংবা কমার আগাম তথ্য ফাঁস করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সিকিউরিটিজ হাউজের কর্মকর্তা কর্মচারী এবং কতিপয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরকে ব্যবহার করে চক্রগুলো।

তারা অর্থের বিনিময়ে হাউজে আগাম তথ্য ফাঁস করে দেয়। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের একটা অংশ হাউজ থেকে তথ্য নিয়ে বিনিয়োগ পরিকল্পনা করে। এর বিনিময়ে হাউজের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নগদ উপহার দাবি করেন। অনেক সময় চুক্তিভিত্তিক তথ্য বিক্রি করা হয়।

সম্প্রতি দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তথ্য বিক্রি করে ফায়দা লোটার কাহিনী। আর এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী, সিকিউরিটিজ হাউজের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কোম্পানির লোকজন জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিনিয়োগকারীকে জনৈক ব্যক্তি একটি কোম্পানির শেয়ার কিনতে বলেন। কারণ হিসেবে তিনি জানেন ঐ কোম্পানির ডিভিডেন্ড কত আসবে। তিনি ব্রোকারেজ হাউজে এসে যা বলছেন ডিভিডেন্ড তাই প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি বস্ত্র খাতের মেট্রো স্পিনিং ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য পাঁচ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করবে আগেই এ খবর বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রোকারেজ হাউসগুলোয় বিনিয়োগকারীদের মুখে আগে থেকেই এ কথা শোনা যায়। পরে কোম্পানির পক্ষ থেকে পাঁচ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়।

এছাড়া ম্যাকসন স্পিনিং ১১-১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ আসছে এমন গুজব রটে। অবশেষে দেখা গেল ১১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করছে। এছাড়া ফরচুন সুজের ১০ শতাংশ ক্যাশ ও পাঁচ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ডের গুজব আগেই রটে। অবশেষে দেখা গেল যা গুজব রটছে তাই লভ্যাংশ আসছে। এছাড়া সোনালী পেপারের প্রথম প্রান্তিকের ইপিএস যা গুজব রটছে তাই কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রকাশ পায়।
একইভাবে ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে প্রকৌশল খাতের আনোয়ার গ্যালভাইজিং। এর মধ্যে ২০ শতাংশ নগদ, বাকি ১০ শতাংশ। কোম্পানির

এ ধরনের লভ্যাংশ ঘোষণা করবে বাজারে আগেই এ গুজব রটে যায়। সম্প্রতি কয়েকটি কোম্পানির সংবেদনশীল তথ্যের কথা উল্লেখ করে অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা বলেন, এসব কোম্পানি যখন অফিশিয়ালি তথ্য প্রকাশ করেছে, এর আগেই তাদের কাছে এ তথ্য ছিল। তবে বিনিয়োগকারীদের জন্য মূল্য সংবেদনশীল তথ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এ তথ্যের ওপর নির্ভর করে বিনিয়োগকারীরা কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা, না করা, শেয়ার বিক্রি কিংবা ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য একটি প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এ তথ্য গোপন রাখার কথা। কিন্তু হচ্ছে এর উল্টোটা। এ তথ্য ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী, এ তথ্য সবার আগে ডিএসই, সিএসই ও বিএসইসির কাছে আসার কথা থাকলেও তাদের কাছে আসছে সবশেষে। ফলে একটি সুযোগসন্ধানী চক্র ফায়দা লুটছে। নষ্ট হচ্ছে বাজারের পরিবেশ। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

জানা গেছে, কোম্পানির লাভ-লোকসান, শেয়ারপ্রতি আয়, নতুন বিনিয়োগ, মালিকানা বদল, কেনাকাটাসহ বাজারের জন্য মূল্য সংবেদনশীল সব তথ্য ফাঁস করছেন কোম্পানির শেয়ার ডিভিশনের লোকজন। কোম্পানি পরিচালকদের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ রয়েছে। এসব তথ্য ইতিবাচক হলে তারা শেয়ার কিনে তারপর বন্ধু-বান্ধবদের মাধ্যমে খবর ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আর নেতিবাচক হলে শেয়ার বিক্রি করে খবর ছড়িয়ে দিচ্ছেন। খবর আগে যারা পান, তারা লাভবান হচ্ছেন। যারা আগে পাচ্ছেন না, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এ বিষয়ে শহিদুল ইসলাম নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন, শুধু এসব খবরই নয়, কোন প্রতিষ্ঠানের ইপিএসই কেমন হবে বা আর্থিক হিসাব কেমন হবে সেসব খবরও আগেই মার্কেটে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও প্রথমে তা কিছু লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং তারা বেশি লাভবান হন। তিনি বলেন, কোনোভাবে যেন এসব তথ্য ফাঁস না হয়, সেদিকে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেয়া দরকার।

সূত্রমতে, যারা আগে থেকে সংবেদনশীল তথ্য পান, তারা সঙ্গে সঙ্গে এটা কাজে লাগাতে শুরু করেন। শেয়ারদর বাড়বে এমন খবর এলে তারা ক্রেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ফলে এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের জন্য বাজারে ক্রেতার সংখ্যা বেশি দেখা যায়। ক্রমে এ শেয়ারের দর বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে তার হাউসগুলো নিজেদের লোক দিয়ে শেয়ারদর বাড়বে এমন গুজব ছড়িয়ে দেয়, যার প্রভাবে শেয়ারদর দ্রুত বাড়তে থাকে। সর্বশেষ যখন এটা স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের কাছে আসে, তখন আর ওই শেয়ারের দর বাড়ার সুযোগ থাকে না।

কিন্তু বিনিয়োগকারীরা না বুঝে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বেশি দরে এ শেয়ার কেনেন। এ সুযোগে আগে যারা তথ্য পেয়েছিলেন, তারা শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। এর কুফল ভোগ করতে হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। বেশিরভাগ সময় যার শিকার হন বাজারে নতুন আসা বিনিয়োগকারীরা। পক্ষান্তরে যখন কোনো কোম্পানির নেতিবাচক খবর আসে, সে খবরও আগে আগেই ফাঁস হয়।

সে সময় নানা গুজব ছড়িয়ে কাক্সিক্ষত দরে শেয়ার বিক্রি করেন সুযোগসন্ধানীরা। পরে যখন খবর পান, তখন আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কিছু করার থাকে না। কারণ তিনি আগেই ফাঁদে পা দিয়ে বসে আছেন।

বিষয়টি নিয়ে কথা বললে ডিএসইর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কোনো কোম্পানি এভাবে তথ্য ফাঁস করছে, এমনটি আমার জানা নেই। তবে যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এমন করে এবং প্রমাণ হয়, তবে অবশ্যই নিয়মানুযায়ী তার শাস্তি হবে।

একই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ফাঁস করে দেয়া অন্যায়। এটা সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন। বিষয়টি আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। কেউ যদি এমন করে এবং তা প্রমাণিত হয় তবে অবশ্যই তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।