দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তাতে আগ্রহ কম। ব্যাংকগুলো এককভাবে তার রেগুলেটরি মূলধনের ২৫ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আইনি সীমা থাকলেও বর্তমানে তা গড়ে ১৫ শতাংশ রয়েছে। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত পুঁজিবাজারে এককভাবে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ রয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। আর সাবসিডিয়ারিসহ এই বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

দেশে ৬০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যক্রম থাকলেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ রয়েছে এমন ব্যাংক রয়েছে ৪৮টি। বিদেশি মালিকানাধীন ৯টি ও বিশেষায়িত ৩ ব্যাংকের কোনো বিনিয়োগ নেই পুঁজিবাজারে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে চারটির বিনিয়োগ রয়েছে হাজার কোটি টাকার ওপরে, যেগুলো রেগুলেটরি ক্যাপিটালের প্রায় ২৩ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। এর বাইরে সাতটি ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। অবশিষ্ট ৩৭ ব্যাংকের বিনিয়োগ আইনি সীমার অনেক নিচে রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর এককভাবে যে বিনিয়োগ রয়েছে, তারমধ্যে প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে ৯ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে বিনিয়োগের ৮ হাজার কোটি টাকা সাবসিডিয়ারিকে ঋণ হিসেবে দেওয়া আছে। আর মূল প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের চেয়ে সাবসিডিয়ারিগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বেশি। গত ৪ নভেম্বর পর্যন্ত সাবসিডিয়ারিগুলোর বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। সাবসিডিয়ারিগুলোর পুঁজিবাজারে যে বিনিয়োগ তার উল্লেখযোগ্য অংশই মার্জিন ঋণ হিসেবে গ্রাহককে দিয়েছে।

আইন অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকগুলো এককভাবে রেগুলেটরি মূলধনের ২৫ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে, যা সাবসিডিয়ারিসহ ৫০ শতাংশ। ২৩ ব্যাংকের মধ্যে পুঁজিবাজারে হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে মাত্র চারটি ব্যাংকের। এগুলো হলো- আল আরাফা ইসলামী, ব্র্যাক, সিটি ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের।

এর বাইরে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক এনআরবিসিও রেগুলেটরি মূলধনের যে আইনি সীমা তার প্রায় পুরোটা বিনিয়োগ করেছে। গত এক বছরেরও বেশি সময় পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ থেকে ব্যাংকগুলো ভালো মুনাফা পেয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিট মুনাফা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। চলতি বছর অধিকাংশ ব্যাংকের সুদ আয় কমলেও বিনিয়োগ থেকে ভালো মুনাফা পেয়েছে বলে বিভিন্ন প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ভালো মুনাফার সুযোগ থাকার পরও ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে এগিয়ে না আসার একটি বড় কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা। পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ গণনা করা হয় বাজার মূল্যের ভিত্তিতে। পুঁজিবাজারে ঊর্ধ্বগতি তৈরি হলে গণনা পদ্ধতির কারণে ব্যাংকের বিনিয়োগ বেড়ে যায়। এর আগে পুঁজিবাজারের বড় উল্লম্ফনের কারণে একটি ব্যাংকের বিনিয়োগ আইনি সীমা অতিক্রম করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জরিমানার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিনিয়োগ আইনি সীমার নিরাপদ দূরত্বে রাখার এটি বড় কারণ বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সমন্বিত রেগুলেটরি মূলধন হিসাবে পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের। গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত পুঁজিবাজারে ব্যাংকটির (সাবসিডিয়ারিসহ) বিনিয়োগ রয়েছে ১ হাজার ৯৫ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির সমন্বিত রেগুলেটরি মূলধনের ৪৯ শতাংশ।

অবশ্য টাকার অংকে পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে সিটি ব্যাংকের। সাবসিডিয়ারিসহ পুঁজিবাজারে এই ব্যাংকটির বিনিয়োগ রয়েছে ১ হাজার ১০৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির সমন্বিত রেগুলেটরি মূলধনের ৪২ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এছাড়া সাবসিডিয়ারিসহ ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা ও ব্র্যাক ব্যাংকের ১ হাজার ৭ কোটি টাকার বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে রয়েছে।

পুঁজিবাজারে সবচেয়ে কম বিনিয়োগ রয়েছে এবি ব্যাংকের। এ ব্যাংকের সমন্বিত রেগুলেটরি মূলধন হচ্ছে ১ হাজার ৫৬৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা, যার মধ্যে সাবসিডিয়ারিসহ সমন্বিত বিনিয়োগ রয়েছে ২৩৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির সমন্বিত রেগুলেটরি মূলধনের ১৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। এছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, যমুনা, উত্তরা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের বিনিয়োগ তুলনামূলক কম রয়েছে।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সমন্বিত রেগুলেটরি মূলধন হচ্ছে ১ হাজার ৫৬৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা, যার মধ্যে সাবসিডিয়ারিসহ ব্যাংকটির সমন্বিত বিনিয়োগ হচ্ছে ২৩৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এ বিনিয়োগ ব্যাংকটির সমন্বিত রেগুলেটরি মূলধনের ১৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের সমন্বিত রেগুলেটরি মূলধন হচ্ছে ৩ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা।

অথচ পুঁজিবাজারে ব্যাংকটির সমন্বিত বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৬৭২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির সমন্বিত রেগুলেটরি মূলধনের ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। যমুনা ব্যাংক সমন্বিত রেগুলেটরি মূলধনের প্রায় ২০ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে পুঁজিবাজারে।

উল্লিখিত সময়ে সাবসিডিয়ারিসহ ইস্টার্ন ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়া পুঁজিবাজারে ৮৫৮ কোটি টাকা থেকে ৮৬৭ কোটি টাকা করে বিনিয়োগ করেছে, যা ব্যাংকগুলোর সমন্বিত রেগুলেটরি মূলধনের ৩২ থেকে ৩৬ শতাংশ। এছাড়া মার্কেন্টাইল, এনসিসি, এনআরবিসি, ওয়ান, প্রিমিয়ার, সোশ্যাল ইসলামী, শাহজালাল, ট্রাস্ট, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ও উত্তরা ব্যাংক সাবসিডিয়ারিসহ সমন্বিত রেগুলেটরি মূলধনের ২২ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে করেছে।

এর বাইরে পুঁজিবাজারের জন্য গঠিত বিশেষ তহবিল থেকেও ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করেছে। গত ১ নভেম্বর পর্যন্ত পুঁজিবাজারের জন্য ৩১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে, যার মধ্যে ১ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ তহবিল থেকে ব্যাংকগুলোর এ বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ গণনার বাইরে রাখা হয়েছে।