দেশ প্রতিক্ষণ, বরিশাল: ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে আগুনে পোড়া এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের ডেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে পোড়া শীতবস্ত্র, ব্যাগ, জুতার পাটি। তার মধ্যেই কী যেন খুঁজছিলেন এক নারী। জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, এখানে আমার লাগেজ ছিল। কাপড়চোপড়ের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রসহ মূল্যবান কাগজপত্র এবং ৬৫ হাজার টাকাও ছিল। তার মুখে শোনা গেল ভয়াবহ অগ্নিকান্ড থেকে বেঁচে যাওয়ার নির্মম ট্র্যাজেডির বর্ণনা।

বরগুনার বাসিন্দা রিনা বেগম বলেন, বিকট একটা শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। হঠাৎ দেখি, পুরো লঞ্চের মধ্যে আগুন আর ধোঁয়া। তাৎক্ষণিক আমার ১৩ বছরের ছেলেকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলি। আগুন থেকে বাঁচার জন্য চারদিকে মানুষের ছোটাছুটি। এর মধ্যে অনেকেই নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছেন। কিন্তু আমার ছেলে তো সাঁতার জানে না। তাই সবাই যখন লাফ দেয় তখনও আমার লাফ দেয়ার ইচ্ছা ছিল না। তখন শুধু ভেবেছি যখন ছেলেই বাঁচবে না তখন আমি বেঁচে থেকে কী হবে।

শেষ পর্যন্ত আগুন যখন আমাদের সন্নিকটে চলে আসে তখন কেন যেন অন্যদের মতো নদীতে লাফ দিয়ে বাঁচার ইচ্ছে জাগে। তাই, আগে ছেলেকে লাফ দিতে বলে আমিও লাফ দেই। আমি পানির অনেক নিচে গিয়ে হঠাৎ করে ভেসে উঠি, তখন সাঁতার দিয়ে ছেলেকে আগলে রেখে অনেক কষ্টে তীরে আসতে সক্ষম হই।

মোঃ আব্দুল্লাহ নামের এক যাত্রী বলেন, আরও অনেকের মতো আমিও নদীতে ঝঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি। কেবিনের যাত্রীর অনেকে সে সুযোগ পাননি। তবে লাফিয়ে পড়া নারী ও শিশুর সবাই তীরে উঠতে পেরেছেন কিনা, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্রী ফাতেমা আক্তার। গত বৃহস্পতিবার তিনি ঢাকায় অবস্থানরত এক ফুফাত বোনকে নিয়ে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে গ্রামের বাড়ি বরগুনায় যাচ্ছিলেন। রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে হঠাৎ আগুন ধরার পর দিশেহারা হয়ে পড়েন সাঁতার না জানা ফাতেমা। এ সময় তিনি (ফাতেমা) মোবাইল ফোনে তার মায়ের পরামর্শে আগুন থেকে বাঁচতে নদীতে ঝাঁপ দেন। ততক্ষণে তিনি অগ্নিদগ্ধ হন। সাঁতার না জানলেও ফুফাত বোনের সহায়তায় পাড়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন ফাতেমা। বর্তমানে তিনি (ফাতেমা) ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেছেন, সুগন্ধা নদীটা খুব বেশি বড় না। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজটি (এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ) কোন এক পাড়ে ভিড়িয়ে নোঙ্গর ফেললে মানুষ দ্রুত তীরে লাফিয়ে উঠতে পারত। কিন্তু লঞ্চের সারেং বা নিয়ন্ত্রণে জড়িত কেউ সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। তিনি আরও বলেন, জলযানটি নদীর মাঝখানে ফেলে চলে যাওয়ার ফলে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মানুষকে পানিতে লাফ দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, তদন্ত শেষে পরবর্তীতে আমরা এ বিষয়ে আরও জানাতে পারব।

দগ্ধ জেসমিনের মৃত সন্তান প্রসব: সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী লঞ্চে দগ্ধ ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারী জেসমিন বেগম (৩৫) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মৃত কন্যাসন্তান প্রসব করেছেন। রবিবার দিবাগত রাতে তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে জেসমিনের মামা মামুন মিয়া বলেন, শনিবার ভোরে চিকিৎসাধীন জেসমিন বেগম একটি মৃত কন্যাসন্তান প্রসব করে।

পরবর্তীতে আমরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক ইউনিটে নিয়ে গেলে চিকিৎসক নবজাতকটিকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন এসএম আইউব হোসেন জানিয়েছেন, প্রাকৃতিকভাবেই জেসমিনের গর্ভপাত হয়েছে। জেসমিনের স্বজনরা জানিয়েছেন, লঞ্চে অগ্নিকান্ডে জেসমিনের বোনের মৃত্যু হয়েছে, ভাই দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। জেসমিনের শরীরের ১২ শতাংশ পুড়ে গেছে।

চিকিৎসকের টাকায় দগ্ধদের ইনজেকশন ॥ লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় দগ্ধ যেসব রোগী বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তাদের সবধরনের খরচ বহন করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অনেকক্ষেত্রে বাইরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হলে তাদের খরচও বহন করছেন চিকিৎসকরা। সোমবার সকালে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দগ্ধ কয়েক রোগী ও তাদের স্বজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

নাসিমা বেগম নামের ৪৫ বছর বয়সের এক রোগী বলেন, সবকিছু হাসপাতালের মধ্যেই হচ্ছে। আমাদের কোন ওষুধ কিনতে হচ্ছে না। ওষুধ চাইতেও হচ্ছে না। নার্সরা এসে দেখে ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসাধীন মহিউদ্দিনের স্বজন সাইফুল ইসলাম বলেন, ডাক্তার একটা ইনজেকশন দিয়েছিলেন, এটা হাসপাতালে ছিল না। এক ডাক্তার নিজের পকেট থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে ইঞ্জেকশন কিনে দিয়েছেন।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মাসরুর উর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এখানে চিকিৎসা নিতে কোন রোগীকেই অর্থ খরচ করতে হচ্ছে না। ঢাকা থেকে আসা সাত চিকিৎসককে চিকিৎসার জন্য ওষুধ থেকে শুরু করে সব সুবিধা দেয়া হচ্ছে।

শেবাচিমে চিকিৎসাধীন সবাই শঙ্কামুক্ত : সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী লঞ্চে দগ্ধ হয়ে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৩৭ জনের প্রত্যেকেই শঙ্কামুক্ত রয়েছেন। সোমবার সকালে তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন শেবাচিমে নিয়োজিত শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মাসরুর উর রহমান। তিনি বলেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনায় শরীরের বিভিন্নস্থান পুড়ে যাওয়া ৩৫ জনসহ মোট ৩৭ রোগী শেবাচিমে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এরমধ্যে দুজন অর্থোপেডিকস বিভাগে ভর্তি রয়েছেন। প্রত্যেকেই শঙ্কামুক্ত। ইতোমধ্যে চারজনের অপারেশন করা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

নিহতদের স্মরণে প্রদীপ প্রজ্বালন : লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে নিহতদের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ও আহতদের রাষ্ট্রীয় অর্থে সুচিকিৎসার দাবিতে মানববন্ধন এবং নিহতদের স্মরণে প্রদীপ প্রজ্বালন কর্মসূচী পালন করা হয়েছে। আকাশ-সড়ক-রেল ও নৌপথ দুর্ঘটনামুক্ত রাখার লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেভ দ্য রোডের আয়োজনে রবিবার সন্ধ্যায় এ কর্মসূচী পালন করা হয়।

সংগঠনের মহাসচিব শান্তা ফারজানার প্রেরিত ই-মেইল বার্তায় জানা গেছে, জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত কর্মসূচীতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মোমিন মেহেদী। অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন- পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ফাতিমা পারভীন, সংগঠনের ভাইস চেয়ারম্যান বিকাশ রায়, জিয়াউর রহমান জিয়া, ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিলের সিনিয়র সহসভাপতি আনজুমান আরা শিল্পী, সাংবাদিক নেতা নাসির উদ্দীন বুলবুল, সফিউর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক মহিদুল ইসলাম, সদস্য আমিনুল ইসলামসহ অন্যরা।