দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার ধসের পর ২০১১ সালে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিত শেয়ারধারণ ন্যূনতম ৩০ শতাংশ ধারণে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। এক যুগেরও বেশি সময় পার হলেও এখনো অনেক কোম্পানি নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ শর্ত পরিপালন করেনি।

সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে ২৫ কোম্পানিকে এক মাসের মধ্যে ন্যূনতম শেয়ার ধারণের শর্ত পরিপালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে নির্ধারিত সময়সীমায় একটি কোম্পানিও তা পরিপালন করতে পারেনি। ব্যর্থ কোম্পানিগুলো নিয়ে এখন বিকল্প চিন্তা করছে কমিশন। এসইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

২০১০ সালের পুঁজিবাজার ধসের প্রেক্ষিতে অধ্যাপক এম খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন এসইসির পুনর্গঠিত কমিশন তালিকাভুক্ত কোম্পানির প্রত্যেক পরিচালককে ন্যূনতম ২ শতাংশ ও উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক করে নির্দেশনা জারি করে।

পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনায় বিশেষ ক্ষমতাবলে ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর এমন নির্দেশনা জারি করলেও শুরুতে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। সর্বোচ্চ আদালত এসইসির পক্ষে রায় দেয়। এরপর পরিচালকদের ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের বিষয়টিতে এসইসি সফল হলেও উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীকালে ২০২০ সালে শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের কমিশন ন্যূনতম শেয়ার ধারণের বিষয়ে কঠোর হলে ২২ কোম্পানি তা পরিপালন করে। তবে ২৫ কোম্পানি এ শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় গত ৬ ডিসেম্বর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ২৫ কোম্পানিকে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের জন্য এক মাস সময় দিয়ে চিঠি দেয় এসইসি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোম্পানিগুলো সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণে ব্যর্থ হলে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেয় কমিশন।

চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি সময়সীমা শেষ হলেও ব্যর্থ কোম্পানিগুলোর কোনোটিই শেয়ার ধারণের শর্ত পরিপালন করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করবে বলে জানিয়েছে এসইসি।

এ বিষয়ে এসইসির কমিশনার ড. শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্ধারিত সময়সীমায় যেসব কোম্পানি শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছে, সেসব কোম্পানির পর্ষদে একাধিক স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করা হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্তমান পর্ষদ অপসারণ করা হতে পারে। কোনো কোনো কোম্পানি অবসায়ন করাও হতে পারে।

বাজারে এসব কোম্পানির ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করছেন এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কোম্পানির পরিচালক হতে আমন্ত্রণ জানানো হবে। এমনকি কোনো কোম্পানি যদি অধিগ্রহণ করতে চায়, তেমন সুযোগও রাখা হতে পারে। মোট কথা আমরা বিকল্প ভাবছি, কীভাবে ন্যূনতম শেয়ার ধারণে ব্যর্থ কোম্পানিগুলোতে সুশাসন ফিরিয়ে আনা যায়। তিনি আরও জানান, বেশকিছু কোম্পানি নতুন করে সময় চেয়েছে। তবে এটি বাড়ানো হবে কিনা, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

পরিশোধিত মূলধনের ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণে ব্যর্থ কোম্পানিগুলো হলো: সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ, স্যালভো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস (আরএসআরএম), প্রাইম ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডায়িং, অলিম্পিক এক্সেসরিজ, ফার্মা এইডস, সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলস, ডেল্টা স্পিনার্স, কাট্টলি টেক্সটাইল, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস, আজিজ পাইপস, অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স, আলহাজ টেক্সটাইল মিলস, অগ্নি সিস্টেমস, অ্যাডভান্ট ফার্মা, অ্যাক্টিভ ফাইন কেমিক্যালস, ফারইস্ট ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ফু-ওয়াং ফুডস, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন, ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্ক, ফ্যামিলিটেক্স বিডি, ফাইন ফুডস, ফু-ওয়াং সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ ও এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট।

গত ৬ ডিসেম্বর এসব কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দেওয়া চিঠিতে এসইসি জানিয়েছে, একাধিক বার আলোচনা, বৈঠক ও সতর্কতার পরে এটি এখনো প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ২০১৯ সালের ২১ মে এসইসির জারি করা নির্দেশনা অনুযায়ী আপনার কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালক এখনো সম্মিলিতভাবে পরিশোধিত মূলধনের ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেননি।

এ পরিস্থিতিতে আপনার কোম্পানিকে আগামী এক মাসের মধ্যে সম্মিলিতভাবে পরিশোধিত মূলধনের ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের লক্ষ্যে ২০১৯ সালের ২১ মে এসইসির জারি করা নির্দেশনা যথাযথভাবে পরিপালন করতে নির্দেশ দেওয়া হলো। অন্যথায় ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর জারি করা নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নেবে এসইসি।

তবে এসইসির কঠোর নির্দেশনার পরও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর শেয়ার ধারণ চিত্রে। বরং এর আগে যেসব কোম্পানি থেকে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তারমধ্যে কিছু কিছু কোম্পানিতে অপসারিত পরিচালকদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এরমধ্যে ফ্যামিলিটেক্স অন্যতম।

শেয়ারধারী পরিচালক না পাওয়ার কারণ হিসেবে বিএসইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কোম্পানিগুলোর দুর্বল মৌলভিত্তি, উৎপাদন বন্ধ ও লোকসানে থাকার কারণে কেউ আগ্রহী হচ্ছেন না। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন। এসব উদ্যোক্তা-পরিচালকরা প্রতি বছর বোনাস লভ্যাংশ দিয়ে পরিশোধিত মূলধন অস্বাভাবিক বাড়িয়েছেন।

তাই এখন কেউ দুই শতাংশ শেয়ার কিনতে চাইলে অনেক বেশি অর্থ দীর্ঘ সময়ের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। আবার বিনিয়োগের বিপরীতে কাক্সিক্ষত রিটার্নও অনিশ্চিত। তাই এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে পরিচালক হতে চাইছেন না কোনো বিনিয়োগকারী।

শিবলী রুবাইয়াতের কমিশন শেয়ার ধারণের শর্ত পরিপালন করতে ২০২০ সালের ২৭ জুলাই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে ৬০ কার্যদিবস সময় বেঁধে দেয়। কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার কিনতে সুবিধাভোগী ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ আইন থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়। ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের সময়সীমা ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর শেষ হয়।

অবশ্য নির্ধারিত সময়সীমায় বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা, সাউথইস্ট ব্যাংক, এবি ব্যাংক, এপেক্স ফুটওয়ার, বারাকা পাওয়ারসহ ২২ কোম্পানি এসইসির শর্ত পূরণ করতে পেরেছে। অবশিষ্ট ২৫ কোম্পানিকে নতুন করে এক মাসের সময় দেওয়া হলেও কোম্পানিগুলা আবারও ব্যর্থ হয়। কিন্তু শেয়ারহোল্ডার পরিচালক না পাওয়ায় কোম্পানিগুলোতে সুশাসন ফিরিয়ে আনা এসইসির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।