দেশ প্রতিক্ষণ, চট্টগ্রাম: রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রামেও। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার হঠাৎই হয়ে উঠেছে গরম। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে অনেক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এই দাম আরও বাড়তে পারে— এমন আভাসও দিচ্ছেন বড় ব্যবসায়ীরা। এদিকে দেশের বৃহৎ খাদ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ-চাক্তাইয়ে কোনো কারণ ছাড়াই পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।

রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বেশি আমদানি হয় গম, ভুট্টা, সরিষা, মটর, ও মসুর ডাল। যুদ্ধের ফলে এসব খাদ্য পণ্য আমদানি এখন ঝুঁকির মুখে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে দেশের বাজারে একাধিক খাদ্যপণ্যের দামের ওপর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। দেশের মোট ভুট্টার চাহিদার ২০ শতাংশ আসে এই রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। সূর্যমুখী তেলের ৮০ শতাংশই আসে এই দুটি দেশ থেকে।

আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ১১০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়ে থাকে। রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে গম। ইউক্রেন থেকেও এই পণ্যটি বাংলাদেশ আমদানি করে।

গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ৮ মাসে দেশে গম আমদানি হয়েছে ২৬ লাখ ৭৫ হাজার ২৭০ টন । এর মধ্যে ইউক্রেন থেকে এসেছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫৮৭ টন এবং রাশিয়া থেকে এসেছে ৩ লাখ ২ হাজার ৮৩৩ টন।

বাংলাদেশের গমের মোট চাহিদার এক তৃতীয়াংশ আসে এই দুটি দেশ থেকে বলছেন বাংলাদেশের বৃহৎ খাদ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন।

তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে রমজানের প্রস্তুতি উপলক্ষে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হয়েছে, তাতে কয়েক মাস দাম স্থিতিশীল থাকবে। তবে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে পণ্য সরবরাহ কমবে। যার কারণে দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতি বছর এই দুটি দেশ থেকে প্রায় ১০০ কোটি টন গম বাংলাদেশে আসে। কিন্তু এই যুদ্ধের কারণে গমের সেই সরবরাহ নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের একাধিক আমদানিকারক জানান, যুদ্ধ শুরু হওয়ায় পর পণ্য আমদানিতে জটিলতা বেড়েছে। এই যুদ্ধের ফলে পণ্য পরিবহনে নানামুখী অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে। অনেকে চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশের বাজারে এসব পণ্যের দামে প্রভাব পড়বে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর জারি করা নিষেধাজ্ঞার ফলে সরাসরি এসব পণ্য কেনা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। যুদ্ধের কারণে এর মধ্যেই গম, সূর্যমুখী তেল আর ভুট্টার দাম বাড়তে শুরু করেছে। গম থেকেই ময়দা, আটা, সুজিসহ বিভিন্ন খাদ্যজাত পণ্য তৈরি করা হয়।

চট্টগ্রামের একজন বেকারি ব্যবসায়ী মুজিবুর রহমান বলছেন, ‘গমের দামে তো আর সরকারি ভর্তুকি থাকে না। এখন আমাদের বেশি দামে কিনতে হলে রুটি-বিস্কুটের দামও বাড়িয়ে দিতে হবে।’

চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ি বাজারের একজন ক্রেতা হুমায়ুন কবির বলছেন, ‘সূর্যমুখী তেলের দামও বেড়ে গেছে। গত মাসেও যে দামে কিনেছি, এই মাসে ২০০ টাকা বেশি দিয়ে পাঁচ লিটারের জার কিনতে হচ্ছে।’ জানা গেছে, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে এছাড়া তুলা, সরিষা ও মসুর ডাল আমদানি করা হয়।

সবমিলিয়ে রাশিয়া, ইউক্রেন ও পশ্চিমা দেশগুলোর এই সংঘাতে বাংলাদেশে তেল, গ্যাস, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে ইতিমধ্যে তেলের দাম বেড়ে রেকর্ড ছুঁয়েছে। আন্তর্জাতিক বেঞ্চ মার্ক বেরেন্ট ক্রুডের তথ্য অনুযায়ী, এখন বিশ্ববাজারে এখন প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ১০৫ ডলার পর্যন্ত উঠে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে গত বছরেই ডিজেলের দাম এক দফা বাড়িয়েছে বাংলাদেশের সরকার।

যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে আর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়লে দেশের বাজারেও দাম বাড়তে পারে— এমন আভাস দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আর দেশের বাজারে দাম বাড়লে তার প্রভাবে পরিবহনের ভাড়া বাড়বে। পণ্য পরিবহনে খরচ বেশি হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্য বাড়বে, যাত্রীদের বেশি ভাড়া গুণতে হবে, এমনকি কৃষি উৎপাদনেও খরচ বেড়ে যাবে।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির পর সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ১২ টাকা বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (২৭ ফেব্রুয়ারি) এই দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। নতুন নির্ধারিত দাম অনুযায়ী আগামী ১ মার্চ থেকে খুচরা বাজারে গ্রাহকদের বোতলজাত সয়াবিন তেলের প্রতি লিটার কিনতে হবে ১৮০ টাকায়।

এক লিটার লুজ সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪৩ টাকা এবং ৫ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৮৭০ টাকা। এছাড়া পাম তেলের দাম লিটার প্রতি ১৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। উৎপাদকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চলতি মাসের শুরুতে তেলের দাম প্রতি টন ১ হাজার ৪০০ ডলার ছাড়িয়েছে।

অয়েল রিফাইনার্স ও ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে গত ২০ দিনে সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে প্রতি টনে ১৭০০ থেকে ১৭২৫ ডলারে পৌঁছেছে। এ কারণে দেশীয় কোম্পানিগুলো দাবি করছে, দাম না বাড়ালে তাদের ব্যাপক লোকসান গুণতে হবে।