দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পি কে হালদার) অর্থ পাচারে সহযোগিতা করার পেছনে ৮৪ জনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যে তাদের তালিকা চুড়ান্ত করে আনা হয়েছে। সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়ার পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছেও তাদের বিষয়ে তথ্য পাঠানো হয়েছে।

তাদের মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তবে তাদের আইনের আওতায় আনার আগ পর্যন্ত পরিচয় গোপন রাখা হচ্ছে। এই ৮৪ জন যাতে দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে না পারেন সেই জন্য পুলিশের একটি সংস্থার কাছে তালিকাটি পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছেও নোটিস পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে চলতি মাসেই তিনটি মামলার অভিযোগপত্র দিতে যাচ্ছে দুদক। মামলাগুলোর তদন্তকাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। অভিযোগপত্র অনুমোদনের জন্য শিগগির কমিশনের কাছে পাঠানো হবে। পি কে কান্ডে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা ও বিদেশে অর্থ পাচার রোধে গতকাল বুধবার দুদক কার্যালয়ে ঊর্ধ্বতনদের একটি বৈঠক গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত হয়েছে।

জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বলেন, ‘পি কে হালদারের মামলাগুলো তদন্তের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। চলতি মাসের মধ্যে অন্তত ৩টি মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের জন্য কমিশনের কাছে জমা দেওয়া হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, পি কে হালদারের অর্থ পাচারের সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে তাদের আইনের আওতায় আনতে যা যা করা দরকার তাই করা হচ্ছে। যাদের নাম এসেছে তাদের বিষয়ে আরও তদন্ত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

পি কে হালদারের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৯টি মামলা হয়েছে। সেগুলোতে শুধু পি কে হালদারকেই নয়, তার অন্য সহযোগীদেরও আসামি করা হয়েছে। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে প্রথম পি কে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা হয়। গত বছরের নভেম্বরে ৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগে পি কে হালদারসহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক।

গত বছরের ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। তার আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে ১২ জন। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পি কে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারি, রাশেদুল হক, অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ আটজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে দুদক ও পুলিশের দুই কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত কতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ৮৪ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে কেউ কেউ দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় ‘বিশেষ বার্তা’ পাঠানো হয়েছে।

ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, ৮৪ জনের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাদের নাম নেই। বেশির ভাগই আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন বা ছিলেন। পি কে হালদারকে দেশ থেকে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে তারা সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন বলে তদন্তে জানা গেছে। যাদের জিজ্ঞাসাবাদ বা আটক করা হয়েছে তারাও সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করেছেন এবং অনেকের নাম বলেছেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোল শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, গত ১৪ মে ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোকনগরের একটি বাড়ি থেকে পি কে হালদার ও তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। তাদের প্রথম দফায় তিন দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়।

মঙ্গলবার আবার আদালতে তুলে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, তাদের কাছে তথ্য আছে গত ১০ বছরে পি কে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন দেশের বাইরে। তার মধ্যে ভারতেই বেশি অর্থ পাচার করেছেন বলে মনে হচ্ছে। ভারতেও তাকে প্রভাবশালীরা সহযোগিতা করেছেন। যার ফলে পি কে ওই দেশের রেশন কার্ড, ভোটার আইডি কার্ড, প্যান ও আধার কার্ডও করে ফেলেছেন।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পি কে হালদারের সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের নামে বিশ্বের সর্বোচ্চ পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলে নোটিস পাঠানো হচ্ছে। তাদের নামের তালিকা দুদক থেকে সংগ্রহ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে নোটিস পাঠানোর সম্ভাবনা আছে।

দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, পি কে হালদারের পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে তাকে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে দুদক কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বেশ কিছু গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে সিদ্ধান্তগুলো বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, কিছু দিনের মধ্যে সুখবর পাবে জাতি। এ ক্ষেত্রে সরকার তাদের নানাভাবে সহায়তা করছে।