তৌফিক ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে একের পর এক কাজ করে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেওয়া ইতিবাচক সিদ্ধান্তেও ঘুরে দাঁড়াতো পারছে না পুঁজিবাজার। ফলে পুঁজিবাজার নিয়ে অজানা আতঙ্ক ভর করছে বিনিয়োগকারীদের।

কারণ কিছু দিন যেতে না যেতে ফের তিন ইস্যুতে অস্থির হয়ে উঠছে পুঁজিবাজার। এর মধ্যে প্রথমত, জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি ও ডলারের পাগলা ঘোড়া এবং ফ্লোর প্রাইস ইস্যুতে নানা গুজব। ফলে কোন কিছুতেই স্থিতিশীল হচ্ছে না পুঁজিবাজার।

ফলে দিন দিন লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে উঠছে বিনিয়োগকারীদের। ফলে পুঁজিবাজার যেন এক পুঁজি হারানোর বাজারে রুপান্তর হয়েছে। সম্প্রতি দেশের পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ বাড়াতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের চার নির্দেশনা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। পুঁজিবাজারে চাহিদা বৃদ্ধি, বিনিয়োগকারীদের আস্থা তৈরিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

এছাড়াও ডিএসইসহ ডিবিএর পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানসহ পুঁচিবাজারের উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু কোন প্রতিশ্রুতি কাজ হচ্ছে না। তবে অভিযোগ রয়েছে ডিবিএ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের নেতারা মুখে এক কথা বললেও বাস্তবে করছেন উল্টো। ওইসব সংগঠনের নেতারা কথায় একশত ভাগ স্বচ্ছ, কিন্তু কাজে-কর্মে একশত ভাগ পিছলা।

তারা কেবল বিএসইসির কর্মকর্তাদের ধোঁকাই দিচ্ছেন, আসলে কাজের কাজ কিছুই করছেন না। বিএসইসির উচিত, তাদের কাজ-কর্ম ও নিজস্ব বিনিয়োগ শক্তভাবে খতিয়ে দেখা। তাহলেই তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে আসবে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি তেল এবং ডলারের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি ও হঠাৎ বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন (বিএমবিএ) এর সভাপতি ছায়েদুর রহমানসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন বা চাচ্ছেন বলে পুঁজিবাজারে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের কোন প্রস্তাব কোথাও দেওয়া হয়নি। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ফ্লোর প্রাইস রাখার ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে রয়েছে।

মুলত তিন ইস্যুর আগুনে এক যুগের দাবি পূরণ ছাই হয়ে গেল। এদিকে, কিছুদিন যাবত পুঁজিবাজারের কতিপয় ভুইফোঁড় সংগঠন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করে খবরের বড় শিরোনাম হচ্ছেন। তারা বিএসইসিকে বাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর এবং নতুন বিনিয়োগ আনার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কোন নমুনা দেখা যাচ্ছে না।

এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার একের পর এক নানা সিদ্ধান্তের পরও পুঁজিবাজারে দরপতন থামছে না। টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের মাঝে পুঁজি হারানোর ভয় কাজ করছে। এদিকে বিশ্ব অর্থনীতির উদ্বেগের মধ্যে সরকার দেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করেছে। এই ইস্যুতে পুঁজিবাজারে নতুন উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে। পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার অব্যাহত দরপতন ইস্যুও যোগ হয়েছে। এই দুই ইস্যুতে পুঁজিবাজারে দরপতন আবারও ভারি হয়ে উঠছে।

তাঁরা বলছেন, এক যুগ যাবত পুঁজিবাজারে ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিট ক্রয়মূল্যে গণনার দাবি চলছিল। পুঁজিবাজারের সব পক্ষই বলছিল, এই দাবি পূরণ হলেই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। স্থিতিশীলতার পথে পুঁজিবাজার অগ্রসর হবে। কিন্তু দাবি পূরণের ঘোষণা আসার পরেও পুঁজিবাজার হাঁটছে উল্টো পথেই।

এদিকে, ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমায় নতুন সার্কুলার হলেও ব্যাংকগুলো এখনো বাজারমুখী হয়নি। পুঁজিবাজারের প্রতি ব্যাংকগুলোর নেতিবাচক মনোভাব এখনো রয়ে গেছে। ব্যাংকগুলোকে কিছুটা বাজারমুখী করা গেলেই বাজারের সার্বিক চেহারা বদলে যাবে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী কাজী হোসাইস আলী বলেন, পুঁজিবাজারে রেগুলেটরদের নানান উন্নয়নে পর কয়েকদিন পুঁজিবাজার ভাল দেখালে পরের কয়েক কার্যদিবস মন্দায় থাকে। ফলে উত্থান-পতনের বৃত্তে পুঁজি হারানোর রেকর্ড বেশি। রেগুলেটরদের কোন উন্নয়নেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পাচ্ছে না পুঁজিবাজার। ঘুরে ফিরে পতন দীর্ঘ হওয়ায় অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি।

অবশ্য মাঝে মাঝে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কর্তৃপক্ষদের বিভিন্ন আশ্বাসে হঠাৎ করেই পুঁজিবাজার ভালো হয়। সেই আশ্বাসে কয়েক কার্যদিবস ঘুরেও দাঁড়ায় পুঁজিবাজার। কিন্তু দিন বদলে ঘুরেফিরে পুঁজিবাজার পতনে গড়াগড়ি।

বিএমবিএ সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, আমরা কোথাও ফ্লোর প্রাইস উঠানো নিয়ে কোন ধরনের প্রস্তাব বা আলোচনা করিনি। তবে অনেকে গুজবে ভুল বুঝছে। বাজারের চলমান অবস্থায় আমরা কেউই ফ্লোর প্রাইস উঠানোর পক্ষে না। হয়তো কেউ ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে গুজব ছড়িয়ে থাকতে পারে। এ ধরনের গুজব থেকে বিনিয়োগকারীদেরকে সতর্ক থাকার আহ্বান করেছেন বিএমবিএ সভাপতি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন বলেন, ‘বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বাজারের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা একটি সমস্যার সমাধানও করতে দেখেছি। তাই বলা যায়, বিএসইসি আর বাংলাদেশ ব্যাংক একসঙ্গে কাজ করলে সামনে আরো ভালো করা যাবে।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘বাজারে বড় বিনিয়োগকারীরা ফিরতে শুরু করেছে। এখন বড় বিনিয়োগ হচ্ছে বাজারে। তা লেনদেনের মধ্য দিয়ে দেখা যায়। এখন দেখা যাচ্ছে প্রতিদিনই হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে। তাই বুঝা যায়, বাজারে বড় বিনিয়োগকারীরা আসতে শুরু করেছে। বাজার দাঁড়াতে বেশি সময় লাগবে না৷

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহি পরিচালক ও মূখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, এই মুহূর্তে ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কমিশনে কোন ধরনের আলোচনা হয়নি এবং কেউ প্রস্তাবও দেয়নি। বিনিয়োগকারীদেরকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এই ফ্লোর প্রাইস দেওয়া হয়েছে, যা তুলে দিয়ে কমিশন সেই সুরক্ষায় আঘাত করবে না।

পুঁজিবাজারে ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিট ক্রয়মূল্যে গণনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত আসার পর টানা তিন কর্মদিবস যাবাত দরপতন চলছে পুঁজিবাজারে। এর মধ্যে রোববার ৮ পয়েন্ট, সোমবার ৪৫ পতনের পর মঙ্গলবার আশুরার ছুটি শেষে আজ বুধবার আরও ৭৮ পয়েন্ট পড়ল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স। অর্থাৎ তিন কার্যদিবসে ১৩১ পয়েন্ট হারাল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্যসূচক।

অথচ প্রতিটি শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর এক্সপোজার লিমিট নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর আগের সপ্তাহে টানা পাঁচ কার্যদিবসে সূচক বেড়েছিল ৩৩১ পয়েন্ট। সেই সঙ্গে লেনদেনেও মিলেছিল ঊর্ধ্বগতি। এরপর গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক সার্কুলারে জানায়, পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট গণনার ক্ষেত্রে শেয়ারের ক্রয়মূল্যকেই বাজারমূল্য ধরা হবে।

এতদিন বাজারমূল্য অথবা ক্রয়মূল্যের মধ্যে যেটি বেশি, সেটিকে ধরেই ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা গণনা করা হতো। এর ফলে কোনো শেয়ারের দর বেড়ে গিয়ে বিনিয়োগসীমা অতিক্রম করলে ব্যাংকগুলো শেয়ার বিক্রি করে দিতে বাধ্য হতো। এটিকে পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি বড় বাঁধা হিসেবে ধরা হতো।

আজ ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৭৮.০৪ পয়েন্ট বা ১.২৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১৮০.৯০ পয়েন্টে। ডিএসইর অপর সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক ১৩.৮১ পয়েন্ট বা ১ শতাংশ এবং ডিএসই-৩০ সূচক ২৬.৬৪ পয়েন্ট বা ১.১৯ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে এক হাজার ৩৫৪.৪২ পয়েন্টে এবং দুই হাজার ২১০.৯৫ পয়েন্টে।

ডিএসইতে আজ টাকার পরিমাণে লেনদেন হয়েছে ৭৯৯ কোটি ১৬ লাখ টাকার। যা আগের কার্যদিবস হতে ২৮৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা কম। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছিল এক হাজার ৮৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকার। ডিএসইতে আজ ৩৭৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৬টির বা ৬.৮৬ শতাংশের শেয়ার ও ইউনিট দর বেড়েছে।

দর কমেছে ২৭৯টির বা ৭৩.৬১ শতাংশের এবং ৭৪টির বা ১৯.৫৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর অপরিবর্তিত রয়েছে। অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই এদিন ২৩০.৫০ পয়েন্ট বা ১.২৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ২০৭.৯০ পয়েন্টে। এদিন সিএসইতে হাত বদল হওয়া ২৬৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ২৪টির, কমেছে ১৯১টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৪৯টির দর। আজ সিএসইতে ১৭ কোটি ১৬ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।