জেলা প্রতিনিধি, সাতক্ষীরা, দেশ প্রতিক্ষণ: প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে মঙ্গলবার সুন্দরবনে আছড়ে পড়তে পারে সিত্রাং। সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন এ তথ্য জানিয়েছেন। তাদের ধারণা, বাংলাদেশের সুন্দরবনে ল্যান্ডফল করে স্থলভাগে ঢুকতে পারে ঘূর্ণিঝড়টি।

আগের দুর্যোগের ক্ষতি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলবাসী। ফের নতুন করে সিত্রাং আতঙ্কে রয়েছেন সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলের মানুষ। দুর্বল বেড়িবাঁধ নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের।

ষাটের দশকে নির্মাণ করা এখানকার বেড়িবাঁধগুলো আর পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। এসব বাঁধ এখন আর সামাল দিতে পারছে না ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা। জিও ব্যাগের বালুর বস্তা আর রিং বাঁধ দিয়ে কোনোরকম টিকিয়ে রাখা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ। এ ছাড়া বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য নেই পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারও।

সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। সে সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকা। এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৩ মে ফণী, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল আঘাত হানে।

সর্বশেষ ২০২০ সালের ২০ মে বিকেলে সুন্দরবনের পাশ দিয়ে সাতক্ষীরা উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এ সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন। যার দগদগে ক্ষত শুকায়নি এখনো।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের শেষ জনপদ সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকা শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন। সুন্দরবনের কুল ঘেঁষা এই দ্বীপ ইউনিয়নের শেষপ্রান্তে খোলপেটুয়া নদীর তীরে বেড়িবাঁধে বসবাস করেন সরবানু বেগম।

তিনি জানান, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর নদীতে বিলীন হয়ে যায় তাদের ভিটামাটি। স্থায়ী মেরামত না হওয়ায় এখনো সেখানে জোয়ার ভাটা চলছে। তখন থেকে তারা বেড়িবাঁধের পাশে একটি ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন।

সরবানু মতোই আতঙ্কে দিন পার করছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধের পাশে বসবাসরত হাজারো পরিবার। দুর্যোগ এলেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন এখানকার মানুষ। দুর্বল বেড়িবাঁধ উদ্বেগের প্রধান কারণ। দুর্যোগে নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লেই বারবার বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় লোকালয়। লবণ পানি ঢুকে বিপর্যস্ত হয় জীবনযাত্রা।

গাবুরা ইউনিয়নের খলিশা বুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুল গাজীর জমি নেই। নদীর পাশে সরকারি খাস জমিতে বসবাস তার। তিনি বলেন, ‘ঝড় এলেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হই আমরা। ঘরবাড়ি ফেলে রেখে সাইক্লোন শেল্টারে যেতে হয়। আমাদের বাড়ি থেকে সাইক্লোন শেল্টারের দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার। তারপরও জীবন বাঁচাতে সবকিছু ফেলে রেখে কষ্ট করে আমরা সেখানে যাই।’

গাবুরার চিংড়ি চাষি শাহানুর আলম বলেন, ‘গতবার আম্পানের সময় আমার প্রায় ২০বিঘা জমির মাছের ঘের নদীর পানিতে তলিয়ে যায়। সেবার অনেক টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখনো সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারিনি। আবার শুনছি নতুন করে ঝড় আসবে। এবার বাঁধ ভাঙলে একেবারে পথে বসতে হবে।’

গাবুরা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ষাটের দশকে উপকূলীয় এলাকায় নির্মিত বেড়িবাঁধ ২০০৯ সালে আইলা ও সবশেষ ২০২০ সালে আম্পানের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এখনো আমাদের ইউনিয়নে বেড়িবাঁধের আটটি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। জোয়ারের পানি বাড়লেই বাঁধ ভেঙে আবারও প্লাবিত হবে বিস্তীর্ণ এলাকা। এর আগে বারবার বাঁধ ভাঙলেও টিকে থাকার স্বার্থে মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে রিং-বাঁধ দিয়ে পানি বন্ধ করে। তবে এখনো স্থায়ী বাঁধ হয়নি। এখন ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর খবরে নতুন করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন এখানকার মানুষ।

এ বিষয়ে গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম বলেন, গাবুরা ইউনিয়নে বাসিন্দা প্রায় ৪৫ হাজার অথচ এখানে সাইক্লোন শেল্টার আছে মাত্র ১৫টি। এত মানুষকে এ কয়েকটি সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া স্কুল, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন পাকা ভবনে অল্প কিছু মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব। এত মানুষকে এ কয়েকটি সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, ঝড়ের চেয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় ভয় বেড়িবাঁধ নিয়ে। আগে থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ কোনো রকমে টিকে আছে। নদীর পানি বাড়লেই বিভিন্ন অংশে ভাঙন তৈরি হতে পারে। সরকার নতুন করে এখানে টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিলেও কাজ শুরু হয়নি।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধগুলো সংস্কার করা হয়েছে। বাকি জায়গাগুলো পর্যায়ক্রমে সংস্কার হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগের আওতায় সাতক্ষীরা জেলায় প্রায় ৭০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ৩৫টি পয়েন্টর প্রায় ২০০ কিলোমিটার।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘আগের কয়েকটি দুর্যোগে আগাম প্রস্তুতি থাকায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমানো গেছে। এবারো আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি।’

তিনি জানান, শ্যামনগর উপজেলায় সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে ১০৩টি। এ ছাড়া স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ অন্য পাকা ভবনে আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে ১৮০টি। এসব কেন্দ্রে প্রায় এক লাখ মানুষকে আশ্রয় দেওয়া যাবে।