আবদুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আজ বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরের দ্বিতীয় দিন। আর ৮ দিন পর আলোচিত ১০ ডিসেম্বর। এদিন ধারাবাহিক বিভাগীয় সমাবেশের অংশ হিসেবে ঢাকায় সমাবেশ করবে বিএনপি। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচির চেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে ১০ ডিসেম্বর নিয়ে। কী হবে ১০ ডিসেম্বরে? বিএনপির এই কর্মসূচি নিয়ে পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে চিন্তিত হওয়ার কথা না বললেও ঢাকাজুড়ে নিচ্ছে ব্যাপক নিরাপত্তার প্রস্তুতি। দুই সপ্তাহের জন্য সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। কর্মরতদের পাশাপাশি ১৫ হাজার অতিরিক্ত পুলিশও আনা হচ্ছে। সবার মনে প্রশ্ন, পুলিশ কি ১০ ডিসেম্বর নিয়ে খুব চিন্তিত?

কেউ কেউ মনে করছেন, জঙ্গি পালিয়ে যাওয়া, সমাবেশ ঘিরে তৃতীয় পক্ষের সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা, মতিঝিলের শাপলা চত্বরের সমাবেশের মতো কোনো কিছুর আশঙ্কা সামনে রেখেই ভেতরে- ভেতরে প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ, যাতে যেকোনো পরিস্থিতি সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।
এদিকে বিএনপি নিজেদের ‘চাহিদামতো’ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ ডিসেম্বর মহাসমাবেশের অনুমতি পেলেও দলটি এখন নয়াপল্টনে নিজেদের কার্যালয়ের সামনে তা করতে অনড়।

এতে সন্দেহ বেড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে। এরই মধ্যে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, মহাসমাবেশ ঘিরে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো নাশকতা হতে পারে। এমন অপতৎপরতা চালাতে দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ‘দায়িত্ব’ পেয়েছেন বলেও তথ্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে।

এছাড়া কোথায় কোথায় নাশকতা হতে পারে এবং এসবের দায়িত্বে কারা রয়েছেন, সে তালিকাও করছেন গোয়েন্দারা। এমন পরিস্থিতিতে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে পুলিশ। এরই মধ্যে নাশকতা ঠেকাতে দেশজুড়ে বিশেষ অভিযানও শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে। মহাসমাবেশের ভেন্যু নিয়ে পুলিশ ও বিএনপির অনড় অবস্থানের কারণে নানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। এর আগেও দেশে নানা রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে জ্বালাও-পোড়াও হয়েছে। নাশকতায় প্রাণ গেছে সাধারণ মানুষের। ১০ ডিসেম্বর ঘিরে কী হবে! সেই বিষয়ে দানা বাধছে আতঙ্কও।

বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, ১০ ডিসেম্বর যদি তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করে সেখানে নাশকতার আশঙ্কা রয়েছে কিন্তু। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, এ ধরনের ঘটনা একমাত্র বিএনপি করেছিল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে, আওয়ামী লীগের এই সংস্কৃতি নেই। শেষ পর্যন্ত যাই হোক না কেন, ১০ ডিসেম্বরের রাজনীতিতে সন্ত্রাস-সহিংসতার সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

আর এ কারণেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ১০ ডিসেম্বরকে ঘিরে একের পর এক বৈঠক করছেন, তারা শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং সহিংসতাকে কোনোভাবে প্রশ্রয় না দেয়ার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এই বাস্তবতায় ১০ ডিসেম্বরের আগে থেকে পাঁচটি রেড জোনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র একটি অনলাইন পোর্টালকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। যে পাঁচটি এলাকায় সন্ত্রাস, নাশকতা এবং অনভিপ্রেত ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছে সেই ৫টি এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে থাকবে এবং কোনো রকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় সেজন্য সজাগ থাকবে। যে পাঁচটি রেড জোন চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে:

১. নয়াপল্টন: নয়াপল্টন বিএনপির প্রস্তাবিত সমাবেশস্থল। বিএনপির কার্যালয়ের সামনে এই সমাবেশের জন্য বিএনপি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আর এ কারণেই পুরো নয়াপল্টন এখন রেড জোন মনে করা হচ্ছে। নয়াপল্টনে ৮ ডিসেম্বর থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবস্থান গ্রহণ করবে এবং সেখানে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে।

২. গুলশান: সরকারের পক্ষ থেকে গুলশানের বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবন সংলগ্ন এলাকাকেও রেড জোন করা হয়েছে এবং সেখানেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য যথেষ্ট মোতায়েন থাকবে যেন কোনোরকম অনভিপ্রেত ঘটনা না ঘটে। একটি শঙ্কা রয়েছে যে, বেগম খালেদা জিয়াকে ১০ ডিসেম্বর বের করে নিয়ে আসা হতে পারে এবং তাকে সমাবেশে হাজির করা হতে পারে। আর এই কারণেই গুলশানে বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবন সংলগ্ন এলাকাকে রেড জোন হিসেবে ডিক্লেয়ার করা হয়েছে।

৩. পুরান ঢাকা: পুরান ঢাকা ইশরাকের নির্বাচনী এলাকায় এবং এ কারণেই সেখান থেকে বড় ধরনের মিছিল এবং উচ্ছৃঙ্খল বিএনপির কর্মীরা যেকোনো উস্কানিমূলক ঘটনা ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এজন্য সূত্রাপুর-কোতোয়ালিসহ পুরান ঢাকার এলাকাকে রেড জোন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থানে থাকবে।

৪. খিলগাঁও: মির্জা আব্বাসের বাড়ি এবং সংলগ্ন এলাকায় বিএনপির বিপুল সংখ্যক কর্মী থাকে এবং এখান থেকেও এক ধরনের উচ্ছৃঙ্খলতা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রচেষ্টা হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে খিলগাঁও রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

৫. কাকরাইল: নয়াপল্টন সংলগ্ন কাকরাইল এলাকায় বিএনপির বিকল্প অবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং বিএনপির কর্মীরা সেখানেও সমবেত হতে পারে বলে অনেকেই ধারণা প্রকাশ করছেন। এ কারণে কাকরাইল এলাকাকেও রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে এর বাইরেও মতিঝিল, শাহবাগসহ আরও কয়েকটি এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে থাকবে বলে জানা গেছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তার বক্তব্যে ইতিমধ্যে বলেছেন, ‘ঢাকা বিভাগীয় মহাসমাবেশের নামে বিএনপি বিশৃঙ্খলা করলে ভুল করবে। বিশৃঙ্খলা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বরদাশত করবে না।’ গত বুধবার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে এক অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এই হুঁশিয়ারি দেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘বিএনপির চাহিদা অনুযায়ীই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলটিকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর পরও তারা নয়াপল্টনেই কেন সমাবেশ করতে অনড়, তা বিএনপিই বলতে পারবে। তবে সমাবেশের নামে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হলে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে পুলিশ সতর্ক রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা এবং জানমাল রক্ষায় সব ধরনের প্রস্তুতি পুলিশের রয়েছে। কাউকেই আইনশৃঙ্খলার অবনতি করতে দেওয়া হবে না। জনদুর্ভোগ যাতে না হয় এবং শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করলে সর্বাত্মক সহায়তা করা হবে।’