ceriamis lagoদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে সিরামিক শিল্প। গ্যাস সমস্যার সমাধান এবং ব্যাংক সুদের হার কমানো হলে সিরামিক শিল্পই হবে আগামীতে দেশের রপ্তানির প্রধান খাত। এই অভিমত সিরামিক শিল্প সংশ্লিষ্টদের।

শিল্প মালিকদের কয়েকজন জানালেন, আন্তর্জাতিক মান, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি এবং শৈল্পিক ডিজাইনের কারণে বাজার দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই শিল্প বর্তমানে অন্যতম সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হয়েছে। দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সিরামিক শিল্পে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং রপ্তানিতেও এই শিল্পের অবদান প্রচুর। দেশে অন্যান্য শিল্পের মতো সিরামিক শিল্পও প্রথমদিকে এগিয়েছে ধীর গতিতে।

গত দু’ দশকে বিকশিত হয়েছে দ্রুত। এখন বছরে প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৫ শতাংশ। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাজার প্রসার লাভ করেছে প্রধানত মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাত ধরেই। আর সংশ্লিষ্টরা মনে করেন যে তুলনামূলকভাবে সুলভ মূল্যের গ্যাস এবং শ্রমের কারণে সিরামিক শিল্প বিকাশ লাভ করেছে।

বাংলাদেশে সিরামিক শিল্প অর্ধ শতাব্দী পুরনো। ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠিত হয় এমসিআই ও ন্যাশনাল সিরামিক কারখানা। এরপর ঢাকা সিরামিক ও তাজমা সিরামিক নামে আরও দুটি কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পাকিস্তান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ স্থাপিত হয় ১৯৬২ সালে। স্বাধীনতা উত্তরকালে এটার নাম হয়েছে পিপলস সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন ( বিসিআইসি ) এর আওতায় স্থাপিত হয় বাংলাদেশ ইনস্যুলেটর এন্ড স্যানিটারি ওয়্যার ফ্যাক্টরি।

বেসরকারি খাতের প্রথম কারখানা মুন্নু সিরামিক। প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালে। বর্তমানে এ খাতে ছোট-বড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এই শিল্পে প্রত্যক্ষও পরোক্ষভাবে প্রায় ৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব দেন সিরামিক শিল্প মালিকরা।

বাংলাদেশে মূলত এখন তিন ধরনের সিরামিক পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। টেবিল ওয়্যার, টাইলস ও স্যানিটারি ওয়্যার। সিরামিক দিয়ে তৈরি হচ্ছে টাইলস, বেসিন, কমোড, কিচেন ওয়্যার, স্যানিটারি ওয়্যার, টেবিল ওয়্যার, মাটির জার, কলস, ফুলের টব, মটকা, টেবিল ওয়্যার, গার্ডেন পট, ভেজ, কিচেন ওয়্যার, ডিনার সেট, টি সেট, কফি মগ, বাটি থেকে শুরু কওে গৃহস্থালির বিভিন্ন জিনিসপত্র।

শাইনপুকুর, মুন্নু, বেঙ্গল ফাইন, স্টান্ডার্ড, পিপলস এবং ন্যাশনাল সিরামিক কারখানা সিরামিক তৈজসপত্রের উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে। আবার আরএকে, ফুয়াং, চায়না-বাংলা, ফার, মধুমতি, এটিআই, সানফ্লাওয়ার, গ্রেটওয়াল, ঢাকা-সাংহাই এবং মীর কোম্পানি টাইলস ও স্যানিটারি পণ্য উৎপাদন করছে।

ইতালি, আমেরিকা, জার্মানি, নরওয়ে, কানাডা, সুইডেন, স্পেন, আরব আমিরাত, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, গ্রিস, তুর্কি, ভারত, রাশিয়াসহ ৫০টির অধিক দেশে সিরামিকের তৈজসপণ্য রপ্তানি হয়। রপ্তানিকৃত সিরামিক পণ্যের ৮০ শতাংশই রপ্তানি হয়েছে ইতালি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডা ও সুইডেনে। সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশি সিরামিকের বাজার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান সিরামিক রপ্তানিকারকরা। তুরস্ক, ভারত, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলেও নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে। উন্নত পণ্য ও সুন্দর নকশার কারণেই দিন দিন বহির্বিশ্বে সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে এবং বেড়েছে বাংলাদেশের সিরামিক পণ্যের বাজার।

সিরামিক শিল্পের অধিকাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। চুনাপাথর, পোড়ামাটি, এলুমিনিয়াম অক্সাইড, এলুমিনিয়াম হাইড্রোঅক্সাইড, জিঙ্ক, তরল সোনাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি এবং জার্মানি থেকে আমদানি করা হয়। চীনা মাটির টাইলস তৈরি করতে ব্যবহৃত কাঁচামালের বেশির ভাগই আমদানি করতে হয়। এসব কাঁচামাল ভারত, চীন, নিউজিল্যান্ড ও জার্মানি থেকে আমদানি করতে হয়।

বিনিয়োগ আসতে পারে সিরামিক খাতে। লাভজনক বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে বিনিয়োগে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের কাছে এভাবেই অপার সম্ভাবনার বার্তা দেয়া হচ্ছে। দেশে বিনিয়োগের জন্য এ মুহূর্তে যে কয়টি সম্ভাবনার খাত রয়েছে, সিরামিক তার অন্যতম।

বর্তমানে দেশে ১৬টি প্ল্যান্টে বৃহৎ পরিসরে সিরামিকের বিভিন্ন উপজাত পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এসব উপজাত পণ্য হচ্ছে মেলামাইন, পোরসেলিন, বোন চায়না, টাইলসওয়্যার, স্যানিটারি ওয়ার প্রভৃতি।

জানা গেছে, বিশ্বে সিরামিক পণ্যের ২০ বিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে। দেশে সার্বিকভাবে চাহিদা রয়েছে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের। আর এ খাতে সম্ভাব্য বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের।

বিনিয়োগ বোর্ডের জুন, দেশে ৫৪টি সিরামিক উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে। তবে নানা কারণে এর বেশিরভাগই বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে ১৬টি প্ল্যান্ট বৃহৎ পরিসরে সিরামিক পণ্য উৎপাদন করছে। তবে বড় তিনটি প্রতিষ্ঠানই অভ্যন্তরীণ মার্কেটের ৬০ শতাংশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রতি বছর সিরামিক প্ল্যান্টগুলোয় ২৩৩ মিলিয়ন পিস সিরামিক পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। এর থেকে রফতানি হচ্ছে বাইরে ৫০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ পণ্যের।

বিনিয়োগ বোর্ড সংশ্লিষ্টদের দাবি, বাংলাদেশে রয়েছে ১৬ কোটি মানুষের বড় বাজার। প্রায় সাড়ে ৫ লাখ পরিবারে খুব কমসংখ্যক ঘর বা বাসাবাড়িই পাওয়া যাবে, যেখানে সিরামিক পণ্য ব্যবহহার হয় না। এর বাইরে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর আয়ের পরিধিও দিনদিন বাড়ছে। এর ফলে মানুষের জীবনমান উন্নত হয়েছে। মানুষের সৌখিন প্রবণতাও বেড়েছে। এতে করে শহর কিংবা গ্রাম সর্বত্রই সিরাপণ্যের অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হচ্ছে।

এতে গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত সিরামিক পণ্য বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মেলামাইন ও পোরসেলিনের চাহিদা বাড়ছে। ফলে সারা দেশে এর বিরাট বাজার তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে গড়ে উঠছে নতুন নতুন দালান কোঠা। এসব দালান কোঠায় সিরামিক উপজাত পণ্যেরও বিরাট চাহিদা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে টাইলস ওয়্যার, স্যানিটারি ওয়্যারের কদর বেড়েই চলেছে।

বিনিয়োগ বোর্ডের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) তৌহিদুর রহমান খান বলেন, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট দেশ। এখানে বিনিয়োগ, অংশদারিত্ব এবং মুনাফার শতভাগ নিশ্চয়তা আছে। আছে নগদ সহায়তা, ট্যাক্স হলিডে সুবিধাসহ অন্যান্য আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা।

এছাড়া দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীর জন্য রয়েছে সমান সুযোগ ভোগের অধিকার। এর বাইরে বিদেশী বিনিয়োগের সুরক্ষায়  ফরেন প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট (প্রমোশন অ্যান্ড প্রটেকশন) অ্যাক্ট ১৯৮০ তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশকে শতভাগ শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা দিচ্ছে।

পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের মুনাফার অর্থ পুনর্বিনিয়োগ কিংবা নিজ দেশে নিয়ে যাওয়ার সুবিধাও রয়েছে। এদিকে মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশই তরুণ ও কর্মক্ষম। এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সিরামিক খাতের কোম্পানিগুলোর ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। গত এক মাসে অধিকাংশ সময় সিরামিকস খাতের শেয়ারের দর একচেটিয়া ভাবে বাড়ছে।

তবে সিরামিকস খাতের মধ্যে সর্বোচ্চ দরে রয়েছে লোকসানে থাকা স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক। এছাড়া এ খাতের মন্নু সিরামিক নামমাত্র শেয়ারপ্রতি মুনাফার বিপরীতে আকাশচুম্বী শেয়ার দর অবস্থান করছে। অথচ কোন কারণ ছাড়াই কোম্পানি ২টির শেয়ার দর অস্বাভাবিক হারে বেড়ে ঝুকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।

দেখা গেছে, সিরামিক খাতের তালিকাভুক্ত ৫টি কোম্পানির মধ্যে ফু-ওয়াং সিরামিক, মন্নু সিরামিক, শাইনপুকুর সিরামিক ও স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকের শেয়ার দর সম্প্রতী অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। যার পেছনে কোন কারণ নেই বলে ডিএসইর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এই ৪টি কোম্পানির মধ্যে আবার বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক : লোকসানে থাকা স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকের শেয়ার দর সবচেয়ে বেশি উল্লম্ফন লক্ষ্য করা গেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই ১৬-মার্চ ১৭)  শেয়ারপ্রতি ১.৫৮ টাকা লোকসান করা কোম্পানিটির শেয়ার দর রয়েছে ১১৭.১০ টাকায়। এমতাবস্থায় কোম্পানিটিতে শেয়ারপ্রতি বিনিয়োগকৃত ১১৭.১০ টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না।

মন্নু সিরামিক :  কোম্পানিটির শেয়ার দর মুনাফার তুলনায় আকাশচুম্বী। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ৯ মাসে ০.১২ টাকা ইপিএসের মন্নু সিরামিকের শেয়ার দর অবস্থান করছে ১০৭.৮০ টাকায়। যাতে মূল্য-আয় অনুপাত (পিই রেশিও) দাড়িয়েছে ৬৭৪এ। অর্থাৎ কোম্পানিটি থেকে বিনিয়োগ ফেরত পেতে ৬৭৪ বছর সময় লাগবে।

ফু-ওয়াং সিরামিক : ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই ১৬-মার্চ ১৭)  শেয়ারপ্রতি ০.৩৮ টাকা মুনাফা করা কেম্পানিটির শেয়ার দর রয়েছে ২২.২০ টাকায়। এমতাবস্থায় কোম্পানিটির পিই অবস্থান করছে ৪৪এ। অর্থাৎ কোম্পানিটি থেকে ২২.২০ টাকার বিনিয়োগ ফেরত পেতে ৪৪ বছর সময় লাগবে।

শাইনপুকুর সিরামিক : লোকসানে থাকা শাইনপুকুর সিরামিকের শেয়ার দর অবস্থান করছে ১৫.৯০ টাকায়। কোম্পানিটির ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই ১৬-মার্চ১৭) শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ০.১৮ টাকা। এ হিসাবে কোম্পানিটিতে শেয়ারপ্রতি বিনিয়োগ করা ১৫.৯০ টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না।

আরএকে সিরামিক : চলতি বছরের ৬ মাসে (জানুয়ারি-জুন)  কোম্পানিটির ইপিএস দাড়িয়েছে ১.৩৮ টাকা। এর আলোকে শেয়ার দর অবস্থান করছে ৫৯.৫০ টাকায়।  যাতে পিই অবস্থান করছে ২২এ। এ হিসাবে কোম্পানিটি থেকে বিনিয়োগ ফেরত পেতে ২২ বছর সময় লাগবে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদেরকে সচেতন হতে হবে। যেসব কোম্পানি থেকে বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কম, সেক্ষেত্রে ঝুকি নেওয়া ঠিক হবে না। আর গুজবে কান না দিয়ে যাছাই-বাছাই করে বিনিয়োগ করা উচিত।