Dhaka-stok-lgদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার থেকে অধিক মূল্য বা প্রিমিয়াম নেওয়াটা বৈধ এ বিধানটিকে পুঁজি করে বাজার থেকে অতিরিক্ত প্রিমিয়াম তুলে নিচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানি। পরবর্তীতে এর মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। কারণ তালিকাভুক্তির কিছুদিনের মধ্যেই অতিরিক্ত প্রিমিয়াম গ্রহণকারী অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দর ইস্যুমূল্যের কাছাকাছি বা তার নিচে নেমে যাচ্ছে।

ফলে আইপিও বিজয়ী হয়েও এখান থেকে লাভবান হতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা। প্রিমিয়ামের ধাক্কা সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছেন তারা। ফলে প্রাইমারি মার্কেট থেকেই বিনিয়োগকারীদের কাঁধে লোকসানের বোঝা চেপে বসেছে।

পুঁজিবাজারে একটি কোম্পানি আসার ক্ষেত্রে তার শেয়ার দর নির্ধারণ হয় তার সম্পদ, সুনাম, ব্যবসায়িক ফলাফল ও সমজাতীয় ব্যবসা করা কোম্পানির ব্যবসায়িক অবস্থার উপর ভিত্তি করে। কিন্তু চলমান কোম্পানিগুলো যে হারে প্রিমিয়াম নিচ্ছে বা বিএসইসি কর্তৃপক্ষ নিতে অনুমোদন দিচ্ছে তা বেশি বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। যা প্রিমিয়াম নিয়ে ২০১২ সালে আইপিওতে আসা কোম্পানিগুলোর ফলাফল দেখলে উপলব্ধি করা যাবে।

তবে কোম্পানিগুলো যে হারে প্রিমিয়াম নিচ্ছে সে হারে মুনাফা বয়ে আনতে পারছে না অধিকাংশ কোম্পানি। তবে প্রিমিয়ামবিহীন কোম্পানির মুনাফা আশানুরুপ বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

একাধিক বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করে বলেন, কোনো নীতিমালা না থাকায় কোম্পানির পরিচালনা পরিষদ ইচ্ছা মতো প্রিমিয়াম আদায় করার সুযোগ নিচ্ছে। পুঁজিবাজারে নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো অধিকহারে প্রিমিয়াম নির্ধারণের কারণে বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশিত মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

অধিক প্রিমিয়ামের কোম্পানিগুলোর আইপিওতে বিনিয়োগ করে প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তায় থাকতে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। এ অবস্থায় শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে অতিরিক্ত প্রিমিয়াম বন্ধের দাবি জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

এদিকে কোম্পানির আইপিও অনুমোদন নিয়েও কিছুটা প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তাদের অভিযোগ, নতুন কোম্পানি আসার আগে ইস্যু ম্যানেজাররা কিছুটা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে আইপিও অনুমোদন নিয়ে আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। পরে সেই দামে শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ বিষয়ে এম সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী নুরুল আজম বলেন, ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনতে হলে তাদের প্রিমিয়াম দিতে হবে। কারণ তাদের সম্পদ মূল্য বেড়েছে এবং বাজারে সুনাম আছে। তবে প্রিমিয়াম নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। এর মধ্যে কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) এবং শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভি) পিই রেশিও দেখতে হবে। তবে যদি ইস্যু ম্যানেজাররা তথ্য ম্যানুপুলেট করে তাহলে কিছু করার নেই। তাই আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অধিক দায়িত্বশীল হতে হবে।

কোম্পানিগুলোকে প্রিমিয়াম বেশি দেয়া হচ্ছে বলে জানান পুঁজিবাজারে বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ। আর এইসব কোম্পানিগুলো লুটপাট করাকে কেন্দ্র করে বাজারে আসে। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর ন্যায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দোষ আছে।

আবু আহমেদ বলেন, একটি কোম্পানি যদি ১০ শতাংশের নিচে মুনাফা করে তাহলে সেই কোম্পানিতে একজন বিনিয়োগকারী কেনো বিনিয়োগ করবে। আর একটি কোম্পানি যদি ১০ শতাংশের নিচে মুনাফা করে সেই কোম্পানিতে লভ্যাংশ আরো কম দেবে।

তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এবিএম মির্জা আজিজুর ইসলাম দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, নতুন কোম্পানি বাজারে আসার ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম নেবে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু অতিরিক্ত নয়। ‘ভালো কোম্পানি প্রিমিয়াম নিয়ে বাজারে আসবে, আর এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবেন এটাই স্বাভাবিক।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে প্রিমিয়াম মাত্রা কতটুকু নির্ধারণ করা হবে। তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে মার্কেটে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’ এছাড়া কোম্পানির পিই রেশিওসহ অন্যান্য দিক বিবেচনা করে প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা উচিত। সেই সঙ্গে কোম্পানির রেকর্ড দেখে প্রিমিয়ামসহ বাজারে আসা কোম্পানিতে বিনিয়োগের পরামর্শ দেন তিনি।

বিএসইসির আইন অনুযায়ী কোনো কোম্পানি তার ক্যাটাগরি অনুসারে প্রিমিয়াম নিতে পারে। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের দাবি বিএসইসির উচিত প্রিমিয়ামের একটি নির্দিষ্ট ছক বেঁধে দেয়া। যাতে করে কোম্পানিগুলো ইচ্ছা মতো প্রিমিয়াম না নিতে পারে।
কোম্পানিগুলো কি হারে মুনাফা করেছে তা নিম্নে তুলে ধরা হল। এক্ষেত্রে একটি কোম্পানি শেয়ারপ্রতি (প্রিমিয়ামসহ) যে টাকা তুলেছে তা দিয়ে নির্ণয় করে দেখানো হয়েছে।

জিবিবি পাওয়ার: কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে শেয়ারপ্রতি ৪০ টাকা (প্রিমিয়াম ৩০ টাকাসহ) করে উত্তোলন করে। যেখানে শেয়ারপ্রতি ২.৫৭ টাকা বা ২৫.৭ শতাংশ হারে আয় নিয়ে আসা কোম্পানিটি ২০১২ সালে ২.১৩ টাকা বা ৫.৩২ শতাংশ ও ২০১৩ সালে হয়েছে ১.৯০ টাকা বা ৪.৭৫ শতাংশ হারে আয় করে।

ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট: কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে শেয়ারপ্রতি ৭৫ টাকা (প্রিমিয়াম ৬৫ টাকাসহ) করে উত্তোলন করে। যেখানে শেয়ারপ্রতি ৪.৫৫ টাকা বা ৪৫.৫ শতাংশ হারে আয় নিয়ে বাজারে আসা কোম্পানিটির ২০১২ সালে ৪.০২ টাকা বা ৫.৩৬ শতাংশ ও ২০১৩ সালে ৩.৪৪ টাকা বা ৪.৫৯ শতাংশ হারে আয় করে।

জিপিএইচ ইস্পাত: কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে শেয়ারপ্রতি ৩০ টাকা (প্রিমিয়াম ২০ টাকাসহ) করে উত্তোলন করে। যেখানে শেয়ারপ্রতি ৩.৬৬ টাকা বা ৩৬.৬ শতাংশ হারে আয় নিয়ে আসা কোম্পানিটির ২০১২ সালে হয়েছে ৩.৫৩ টাকা বা ১১.৭৭ শতাংশ ও ২০১৩ সালে হয়েছে ২.৩২ টাকা বা ৭.৭৩ শতাংশ হারে আয় করে।

বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল: কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে শেয়ারপ্রতি ৩৫ টাকা (প্রিমিয়াম ২৫ টাকাসহ) করে উত্তোলন করে। যেখানে শেয়ারপ্রতি ৩.৪৯ টাকা বা ৩৪.৯ শতাংশ হারে আয় নিয়ে আসা কোম্পানিটি ২০১২ সালে ৭.৮৫ টাকা বা ২৫ শতাংশ ও ২০১৩ সালে ৬.৬৯ টাকা বা ১৯.১১ শতাংশ হারে করে।

এনভয় টেক্সটাইল: কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে শেয়ারপ্রতি ৩০ টাকা (প্রিমিয়াম ২০ টাকাসহ) করে উত্তোলন করে। যেখানে শেয়ারপ্রতি আয় ৪.৪২ টাকা বা ৪৪.২ শতাংশ হারে আয় নিয়ে বাজারে আসা কোম্পানিটির ২০১২ সালে ৪.২৪ টাকা বা ১৪.১৩ শতাংশ ও ২০১৩ সালে ৩.১৯ টাকা বা ১০.৬৩ শতাংশ হারে।

সায়হাম কটন: কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে শেয়ারপ্রতি ২০ টাকা (প্রিমিয়াম ১০ টাকাসহ) করে উত্তোলন করে। যেখানে শেয়ারপ্রতি ৩.০২ টাকা বা ৩০.২ শতাংশ হারে আয় নিয়ে আসা কোম্পানিটির ২০১২ সালে ২.৪৮ টাকা বা ১২.৪ শতাংশ ও ২০১৩ সালে ১.৯২ টাকা বা ৯.৬ শতাংশ হারে আয় করে।

জিএসপি ফাইন্যান্স: কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে শেয়ারপ্রতি ২৫ টাকা (প্রিমিয়াম ১৫ টাকাসহ) করে উত্তোলন করে। যেখানে শেয়ারপ্রতি ৩.৫১ টাকা বা ৩৫.১০ শতাংশ হারে আয় নিয়ে আসা কোম্পানিটির ২০১২ সালে ১.৮৮ টাকা বা ৭.৫২ শতাংশ ও ২০১৩ সালে হয়েছে ১.৫০ টাকা বা ৬ শতাংশ হারে।

আমরা টেকনোলজি: কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ২৪ টাকা (প্রিমিয়াম ১৪ টাকাসহ) করে পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করে। যেখানে শেয়ারপ্রতি ২.৬৩ টাকা বা ২৬.৩ শতাংশ হারে আয় নিয়ে আসা কোম্পানিটি ২০১২ সালে ২.৪৬ টাকা বা ১০.২৫ শতাংশ ও ২০১৩ সালে হয়েছে ১.৪৬ টাকা বা ৬.০৮ শতাংশ হারে আয় করে।

জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন: কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে শেয়ারপ্রতি ১০ টাকা করে উত্তোলন করে। যেখানে শেয়ারপ্রতি ২.০৯ টাকা বা ২০.৯ শতাংশ হারে আয় নিয়ে বাজারে আসা কোম্পানিটি ২০১২ সালে ২.০১ টাকা বা ২০.১ শতাংশ ও ২০১৩ সালে হয়েছে ২.১৫ টাকা বা ২১.৫ শতাংশ হারে।

২০১২ সালে বাজার পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে প্রিমিয়াম নেননি বলে জানান জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনের পরিচালক মার্ক নিরঞ্জন চৌধুরী। তবে তারা যদি ওই সময় প্রিমিয়াম নিতেন তাহলে তার ফলও পাওয়া যেত বলে বিশ্বাস করেন তিনি। যা কোনভাবেই বর্তমান মুনাফার হার থেকে কম হত না।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সদস্য শাহাদাত হোসেন ফিরোজ বলেন, ‘২০১০ সালের ধসের পর বিনিয়োগকারীদের লোকসান পোষানোর জন্য আইপিওতে কোটা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত প্রিমিয়ামের কারণে বিনিয়োগকারীরা সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বর্তমান পরিস্থিতি প্রিমিয়াম তুলে দেওয়া উচিত’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে এ ধরনের কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেওয়া প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারি তদন্ত কমিটির প্রধান ও কৃষি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিদ খালেদ বলেন, ‘পুঁজিবাজারে নতুন কোম্পানি আসবে এটা ভালো খরব। তবে যে সকল কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের কাছে থেকে অর্থ সংগ্রহ করবে তাদের আর্থিক ভিত্তি কেমন তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব বিএসইসির।’

তিনি বলেন, ‘কোম্পানি প্রিমিয়াম পেতেই পারে। তবে সেটা কোম্পানির মৌলভিত্তির বিচারে হওয়া দরকার। কারণ দুর্বল কোম্পানি যদি পুঁজিবাজারে আসার সুযোগ পায়, তবে তা বিনিয়োগকারী এবং বাজার কারো জন্য ভালো হবে না। বিএসইসিকে সেই বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে।’

একই বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সাবেক সভাপতি এবং বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘বাজার থেকে প্রিমিয়াম নেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে এ কথা সত্যি। তবে যারা কোম্পানিকে বাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেয়,তাদের উচিৎ প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নেওয়া। কোম্পানির সার্বিক অবস্থার উপর নির্ভর করে সেই কোম্পানি কতোটা প্রিমিয়াম পাবে।