northern-jute-tdpআসিফুজ্জামান পৃথিল, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: কার্পেটসহ পাটজাত দ্রব্যের পরিকল্পনা নিয়ে কুষ্টিয়ার বিসিক শিল্পনগরীতে স্থাপন করা হয় নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোং লিঃ। উন্নতমানের সুতলী আর পাটজাত দ্রব্যাদি উৎপাদনের জন্য ব্যাপক সুনাম অর্জন করে এ প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু অব্যবস্থাপনার কারণে কুষ্টিয়ার একমাত্র পাটকল নর্দান জুট ম্যানু ফ্যাকচারিং কোং লিঃ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। শ্রমিকদের ৮০ টাকা বেতন দিয়েও প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

জানা যায়, কুষ্টিয়ার কুমারগাড়া এলাকার বিসিক শিল্পনগরীতে ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা হয় নর্দান জুট ম্যানু ফ্যাকচারিং কোং লিঃ। প্রতিষ্ঠার শুরুতে প্রায় ৪০০ শ্রমিক অত্র প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো। কিন্তু বর্তমানে শ্রমিক সংখ্যা মাত্র ৮০ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে যে উন্নতমানের সুতলী উৎপাদিত হয় তা দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রফতানি করা হয়। এখানকার উৎপাদিত সুতলী আমেরিকা, জাপান ও মিসরে রফতানি করা হয়।

কিন্তু সে সুনাম আজ স্নান হতে চলেছে। মিল কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণে বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে প্রতিষ্ঠানটি। মিলটিতে এখন ১৩টি স্পিং ফ্রেম মেশিন আছে যাতে কাজ করার জন্য এই ৮০ জন শ্রমিক অপ্রতুল। বেতন-ভাতা কম হওয়ার শ্রমিকরা কাজ করতে চায় না। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময় চাল যেখানে ৬৫ টাকা কেজি সেখানে নর্দান জুট মিলের একজন শ্রমিকের দিনে হাজিরা মাত্র ৮০ টাকা।

এই স্বল্প বেতনে এখানে শ্রমিকরা বেশি দিন কাজ করে না। এছাড়া শ্রমিকদের চিকিৎসা, বাড়ি ভাড়াসহ অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। অত্র প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর লাভের মুখ দেখলেও শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতিকল্পে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বর্তমানে কুষ্টিয়ার একমাত্র পাটকলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। শ্রমিক ও মিল কর্তৃপক্ষ এখন দুই মেরুতে অবস্থান করছে।

এই মিলের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে মিল কর্তৃপক্ষের কাছে শ্রমিকদের বেতনভাতা বৃদ্ধির জন্য বারবার চিঠি দেয়া হয়েছে কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো ভূমিকা নিচ্ছে না বরং শ্রমিকদের বিরুদ্ধে উল্টা চিঠি ইস্যু করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে শ্রমিকরা।

আগে যেখানে প্রতি সপ্তাহে ৫ থেকে ৬ ট্রাক পাট ক্রয় করা হতো, সেখানে বর্তমানে ১ ট্রাক পাট ক্রয় করে এবং মাঝেমধ্যে পাট থাকেও না। ফলে স্বাভাবিকভাবে মিলের উৎপাদন কমে গেছে। আর শ্রমিকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা রকম ক্ষোভ।

মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ইসলাম উদ্দিন জানান, মিলটি প্রতি বছর লাভের মুখ দেখলেও শ্রমিকদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি। বরং মিলটি নিয়ে এক শ্রেণীর চক্রান্তকারীরা উঠেপড়ে লেগেছে। আমরা প্রতিদিন ৮০ টাকা করে হাজিরা পেলেও মিলটি বন্ধ করার চক্রান্ত করা হচ্ছে। মিল বন্ধ নয় মিলের উপকরণ সরবরাহ করে মিলটির উৎপাদন বাড়িয়ে মিলটির আরো উন্নয়ন সম্ভব।

কিন্তু বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে আমাদের যে মজুরি দেয়া হচ্ছে তা কোনক্রমেই সংসার চলে না। উপরন্তু আমাদের মজুরী না বাড়িয়ে মিলটি নিয়ে নোংরা রাজনীতি শুরু করা হয়েছে। একই অভিযোগ করলেন মিলটির শ্রমিক সিরাজ আলী, আক্কাচ আলী ও মহিলা শ্রমিক রোকেয়া খাতুন।

তাদের সকলের অভিযোগ মিলটিতে কাজ করেও তারা ন্যায্য মজুরি পায় না। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। মিলটি আজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে মিলের শ্রমিক আর কর্মচারীরা। তাদের দাবি মিলটিতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহ করে মিলের উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করলেই শ্রমিকরা মিল ও কর্তৃপক্ষের প্রতি আন্তরিক হবে। উৎপাদন বৃদ্ধি ও মিলের উন্নতিও ঘটবে।

এ ব্যাপারে মিলের ম্যানেজার আমানউল্লাহ জানান, মিলের চাহিদা অনুযায়ী মালামাল সরবরাহ করা হচ্ছে। শ্রমিকরা যেভাবে কাজ করছে সেভাবেই মজুরি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এরপরেও নর্দান জুটের শেয়ারদরের উল্লম্ফন থামেনি। ১ বছর আগে ১০১৬ সালের ১৩ নভেম্বর কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ছিল ২২৭.৩০ টাকা।

২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি শেয়ারটির দর ২৩৭.৭০ টাকায় পৌছায়। এরপর শুরু হয় ব্যাপক উল্লম্ফন। ৪ মে ২০১৭ থেকে ২২ মে ২০১৭ এই ১৮ দিনে কোম্পানিটির শেয়ারদর এক লাফে ৩৫৪-৫৩৫ টাকায় উঠে যায়। নর্দান জুটের মতো দূর্বল মৌলভিত্তির একটি কোম্পানির পক্ষে এরকম উত্থান অস্বাভাবিকই বটে।

কিন্তু এরপরেও থামেনি কোম্পানিটির অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি। ২৭ আগস্ট তারিখে প্রতিটি শেয়ারের দাম ৬৯৬.২০ টাকায় উঠে যায়! এরপর অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির মতো অস্বাভাবিক দরপতনের ঘটনাও ঘটে। ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর মাত্র ১৫ দিনে শেয়ারদর ৬৭৭.৩০ টাকা থেকে ৪০৯.৫০ টাকায় নেমে আসে।

বাজারে জোর গুজব আছে যে, নর্দান জুট কৃত্তিমভাবে শেয়ারের দর বাড়িয়েছে। কোম্পানির পরিচালকরা নিজেরাই বেনামে শেয়ার কিনে কৃত্তিমভাবে দর বানিয়ে বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটি আবারও হঠাৎ করে লোকসান দেখানোও গুঞ্জন আবারও বেড়ে গেছে।

অভিযোগের আঙুল কোম্পানিটির চেয়ারম্যান, উজ্জ্বল কুমার নন্দী এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনঙ্গ কুমার রায়ের প্রতি। মাত্র ১ মাস আগে ২০ শতাংশ ক্যাশ এবং ২০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষনা করা কোম্পানিটি এই বছরের প্রথম প্রান্তিকে ৪.০৪ টাকা শেয়ারপ্রতি লোকসান দেখিয়েছে। আগের বছর একই সময়ে যার পরিমান ছিল ৩.০২ টাকা।

যেই কোম্পানি ৪০ শতাংশ লভ্যাংশ দেবার ক্ষমতা রাখে সেই একই কোম্পানি মাত্র একটি প্রান্তিকের ব্যাবধানে ৪ টাকার বেশী শেয়ারপ্রতি লোকসান দেখানোয় বাজারে আরোও গুঞ্জন বেড়ে গেছে। তাহলে কি, কোম্পানির পরিচালকরা শেয়ার কারসাজির উদ্দেশ্যেই এই লভ্যাংশ নাটক করেছেন। বাজার সংশ্লিষ্ট সবার মুখেমুখে এখন এই প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এ ব্যাপারে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনঙ্গ কুমার রায়ের যোগাযোগ এর চেষ্টা করলেও তাঁর মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।