NTLদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশলী খাতের কোম্পানি ন্যাশনাল টিউবস লিমিটেডের শেয়ারের দর কোন কারন ছাড়াই টানা বাড়ছে। ফলে এ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগ তুলছেন বিনিয়োগকারীরা। ন্যাশনাল টিউবসের মূল্যসংবেদনশীল তথ্য ফাঁস করে শেয়ারের দর বাড়ানোর অভিযোগ করেছেন একাধিক বিনিয়োগকারীরা।

আর খোদ অভিযোগের তীর উঠছে কোম্পানিটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে কোম্পানিটির কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই বেশিরভাগ তথ্য ফাঁস হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ন্যাশনাল টিউবস নিয়ে ভিত্তিহীন মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ফেসবুকে ছড়ানো হচ্ছে। তবে এসব খবরের উপর ভিত্তি করে কোম্পানিটির শেয়ারদর টানা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

এ বিষয়ে ন্যাশনাল টিউবসের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমার দৃষ্টিতে শেয়ারের দর বাড়ার বা কমার কোন কারন আমাদের জানা নেই। তবে কিজন্য বাড়ছে তা আমরা বুঝি না। তবে মূল্যসংবেদনশীল তথ্য ফাঁসের অভিযোগ অস্বীকার করেন।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা এ ঘটনাকে মূল্যসংবেদনশীল তথ্য ফাঁসের তথ্য বাজারে ছড়ানোকে ইনসাইডার ট্রেডিং বলেছেন। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কথিত ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের কবলে পড়ে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।

এদিকে ন্যাশনাল টিউবস গ্যালভানাইজিং প্ল্যান্ট স্থাপন করবে এমন সিদ্ধান্ত রোববার কোম্পানিটির পর্ষদ সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর এমন খবর বাজারে আগে ছড়িয়ে পড়েছে। ন্যাশনাল টিউবস গ্যালভানাইজিং প্ল্যান্ট স্থাপন করলে কোম্পানিটির বছরে ৭ কোটি টাকার ব্যবসা হবে। কোম্পানিটি, প্ল্যান্টে পিডিবি, আরইবি, ডেসা, ডেসকোর বিভিন্ন ধরনের টাওয়ার, ফিটিং ও আইবীম ইত্যাদি এবং মোবাইল কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন ধরনের টাওয়ার গ্যালভাইজিং করা হবে সুত্রে জানায়।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে একটি দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে এসব তথ্য সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত থাকে। এ তথ্যের ভিত্তিতে তারা প্রথমে নিজেরা শেয়ার কিনে নেয়। পরে বাজারে নানা গুজব ছড়িয়ে শেয়ারের দর বাড়িয়ে এক পর্যায়ে বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করে সটকে পড়ে। গুজবে কান দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়ত এভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে এসব গুজব সত্যও হয়।

এদিকে গত তিন বছর আগেও ন্যাশনাল টিউবস মুনাফায় ছিল। কিন্তু এরপর থেকেই কোম্পানিটি লোকসানের পথে ধাবিত হয়। প্রতি বছর কোম্পানিটির উৎপাদন ও বিক্রি কমছে। ফলে প্রতি বছরই এর লোকসানের পাল্লাও ভারি হচ্ছে।

জানা যায়, ন্যাশনাল টিউবসের মূল পণ্য গ্যাস লাইনের পাইপ। কিন্তু গত ৩ বছর যাবত আবাসিক স্থাপনায় নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদান বন্ধ রয়েছে। ফলে কোম্পানিটির পণ্যের চাহিদা অনেক কমে গেছে। শিল্প-কারখানায় সীমিত পরিসরে গ্যাস সংযোগ দেয়ার প্রক্রিয়া চালু থাকলেও তা কোম্পানিটির সক্ষমতা ও উৎপাদনের বিপরীতে যথেষ্ট নয়।

এ কারণে তিন বছরের ব্যবধানে ৬২ দশমিক ৯৪ শতাংশ বিক্রি কমে লোকসানে পড়েছে প্রকৌশল খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিটি। সর্বশেষ হিসাব বছরে ৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার নিট লোকসান দেখিয়েছে ন্যাশনাল টিউবস।

কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, ন্যাশনাল টিউবসের উৎপাদিত পণ্যের ৯০ শতাংশ এপিআই পাইপ, যার প্রধান ক্রেতা পেট্রোবাংলা। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বাসা-বাড়িতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে পেট্রোবাংলা। বিশেষ বিবেচনায় শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ অব্যাহত থাকলেও তা অত্যন্ত সীমিত পরিসরে। এ কারণে ন্যাশনাল টিউবসের কাছ থেকে পাইপ ক্রয় কমিয়ে দিয়েছে পেট্রোবাংলা এবং এর অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলো।

অন্যদিকে শিল্প-কারখানার নতুন গ্যাস সংযোগের নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা না থাকায় আগাম ক্রয়াদেশ দেয়ার পরও সে পরিমাণ পাইপ কিনছে না তারা। ফলে ন্যাশনাল টিউবস তাদের পাইপের উৎপাদন অব্যাহত রাখলেও তা বিক্রি করতে পারছে না।
শিল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া সর্বশেষ প্রতিবেদনে ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা নিট লোকসান দেখিয়েছে ন্যাশনাল টিউবস। যদিও তিন বছর আগে ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে সাড়ে ১২ কোটি টাকা মুনাফা ছিল কোম্পানিটির।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টিউবসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ছাইদুর রহমান জানান, ন্যাশনাল টিউবসের পণ্যের ৯০ শতাংশের ক্রেতা পেট্রোবাংলা। গত তিন বছর বাসা-বাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় তারা পাইপ কম কিনছে। তাদের ক্রয়াদেশের ভিত্তিতে পাইপ উৎপাদন করলেও বছর শেষে অবিক্রীত থেকেছে অনেক পণ্য। এদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়ন হওয়ায় বেতন-ভাতা বাবদ কোম্পানির ব্যয় বেড়েছে। ফলে বছর শেষে লোকসানের মধ্যে পড়েছে কোম্পানি।

কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরো জানান, পেট্রোবাংলা, ওয়াসা, বিপিসিসহ সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টিউবসের পণ্য কিনত বলে এক সময় বেসরকারি পর্যায়ে বিক্রির প্রয়োজন ছিল না। সেখানে চাহিদা কমায় আমরা বিকল্প বাজারের কথা ভাবছি। এছাড়া এপিআই পাইপ নির্ভরতা কমিয়ে জিআই পাইপ উৎপাদনের জন্য কোম্পানির গ্যালভানাইজিং প্লান্টটি আবার চালু করা হয়েছে।

বর্তমানে এ পাইপ উৎপাদনেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে ন্যাশনাল টিউবস। বেসরকারি পর্যায়ে বিক্রি বাড়াতে বিভিন্ন স্থানে নিজস্ব শো-রুম স্থাপনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আশা করছি, আগামীতে কোম্পানির বিক্রি বাড়বে।

ন্যাশনাল টিউবসের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত তিন বছরে ন্যাশনাল টিউবসের পণ্য বিক্রি ৬২ দশমিক ৯৪ শতাংশ কমেছে। ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে এর পণ্য বিক্রয় ছিল ৭০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। পরবর্তী দুই বছর তা ধারাবাহিক কমে ২০১৪-১৫ সালে ৫৪ কোটি ২২ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে ৩৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ও সর্বশেষ হিসাব বছরে ২৬ কোটি ২৩ লাখ টাকায় নেমে এসেছে।

এদিকে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট ক্রয়াদেশ না থাকায় পণ্য উৎপাদন কমায়নি ন্যাশনাল টিউবস। বিক্রি কমলেও কমেনি উৎপাদন খরচ। এমতাবস্থায় পরিচালন ব্যয় কমানোর চেষ্টা থাকলেও মুনাফা ধারাবাহিকভাবে কমে সর্বশেষ হিসাব বছরে এসে লোকসানে পড়েছে কোম্পানিটি।

কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে ন্যাশনাল টিউবসের নিট মুনাফা ছিল ১২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। ধারাবাহিকভাবে কমে ২০১৪-১৫ হিসাব বছরে ৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা ও ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে তা মাত্র ১৭ লাখে নেমে এসেছে। আর ৩০ জুন সমাপ্ত হিসাব বছরে নিট লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা।

এদিকে ৩০ জুন সমাপ্ত ২০১৭ হিসাব বছরে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে ন্যাশনাল টিউবসের পরিচালনা পর্ষদ। সমাপ্ত বছরে এর শেয়ারপ্রতি লোকসান দাঁড়িয়েছে ২ টাকা ৮৬ পয়সা। যদিও আগের বছর শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৩ পয়সা। নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন, লভ্যাংশ ও অন্যান্য এজেন্ডা বাস্তবায়নে ২৪ ডিসেম্বর টঙ্গীতে অবস্থিত কারখানা প্রাঙ্গণে বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আহ্বান করেছে ন্যাশনাল টিউবস। এজন্য রেকর্ড ডেট নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭ নভেম্বর।

জানা গেছে, ১৯৬৪ সালে আদমজী গ্রæপ কর্তৃক আদমজী পাইপ নামে ব্যক্তিমালিকানায় যাত্রা করে ন্যাশনাল টিউবস। তাদের মূল পণ্য ছিল ১/২ ইঞ্চি হতে ৪ ইঞ্চি ব্যাসের জিআই ও এমএস পাইপ, যা গৃহস্থালির পানি সরবরাহ ও সেচকাজে ব্যবহার হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করে কোম্পানিটিকে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) অধীনে আনা হয়।

প্রতিষ্ঠানের নাম হয় ন্যাশনাল টিউবস। পরবর্তীতে তেল ও গ্যাস সঞ্চালন কাজে ব্যবহারের জন্য ৩/৪ ইঞ্চি হতে ৮ ইঞ্চি ব্যাসের এপিআই পাইপ উৎপাদনে যায় কোম্পানিটি।

পরবর্তীতে তেল ও গ্যাস লাইনের সংযোগের জন্য ব্যবহূত এ পাইপটিই প্রধান পণ্যে পরিণত হয় ন্যাশনাল টিউবসের, যার ৯০ শতাংশের ক্রেতা পেট্রোবাংলা। ন্যাশনাল টিউবসের কারখানার তিনটি ইউনিটের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৪৫ হাজার মেট্রিক টন হলেও গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় ৫ হাজার টনের বেশি পণ্য উৎপাদন করছে না প্রতিষ্ঠানটি।

আদমজী গ্রæপের মালিকানায় ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল টিউবস ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় যায়। পরবর্তীতে কোম্পানিটি ১৯৮৯ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়।

কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন ১০০ কোটি ও পরিশোধিত মূলধন ২৬ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। রিজার্ভ ৫৪৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। বর্তমানে কোম্পানির দশমিক ৫ শতাংশ শেয়ার এর উদ্যোক্তা-পরিচালকদের কাছে, বাংলাদেশ সরকার ৫১ শতাংশ, প্রতিষ্ঠান ১৫ দশমিক ৬০ ও বাকি ৩২ দশমিক ৯০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে।