দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: একটানা ভারী বর্ষণ আর উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যে তিস্তায় সারাবছর পানির জন্যে হাহাকার থাকে। খরার ফলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়, সেই তিস্তায়-ই এখন স্রোতের গর্জন। তিস্তার উপচেপড়া পানিতে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে একের পর এক গ্রাম।

পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। ধীরে ধীরে বন্যা দেশের মধ্যাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে। শনিবার বিকেলে তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানির প্রবাহিত হচ্ছিল।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক উপ-সহকারী প্রকৌশলী আমিনুর রশিদ জানান, উজানের ঢল সামাল দিতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইস গেটের (জলকপাট) সবই খুলে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া তিস্তা বিপদসীমার ওপরে চলে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানের বাঁধগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। নদীর দুই কূল ছাপিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে।

গত দুই দিন ধরে তিস্তার পানি অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গোড্ডিমারী ইউনিয়নে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজের উত্তর প্রান্তের ফ্লাড বাইপাস সড়কটি যে কোনো মুহূর্তে কেটে দেয়া হতে পারে বলে জানান কর্মকর্তারা। এ কারণে তিস্তা ব্যারাজের আশপাশে এবং ফ্লাড বাইপাস সড়কটির উজানে ও ভাটিতে বসবাসকারী লোকজনসহ নদী তীরবর্তী লোকজনকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। একইসঙ্গে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কায় এই এলাকায় রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে।

অন্যদিকে ঢলের পানিতে নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকার প্রায় ১৫টি চর ও চরগ্রাম হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে তলিয়েছে। তিস্তার পারের জেলাগুলোর লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

এছাড়া উজানের ঢলে কুড়িগ্রামের সবকটি নদ-নদীর পানি বাড়ছে। ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানিও বেড়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে গত ২৪ ঘণ্টায় চর ও দ্বীপ চরসহ নদী তীরবর্তী নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে সাতটি উপজেলার অর্ধ শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, শনিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া তিস্তা নদীর পানি বাড়লেও কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার শৌলমারী বানপাড়ায় ডানতীর গ্রাম রক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ওই এলাকার বাসিন্দা আশরাফ আলী জানান, ‘পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব আতঙ্কে আছি। এই বাঁধ ভেঙে শুধু বানপাড়ায় নয়, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের ২০ হাজারেরও বেশি পরিবারের ঘরবাড়ি তিস্তা নদীর পানিতে তলিয়ে যাবে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, ‘বানপাড়া বাঁধ ৬০ মিটার পর্যন্ত ভাঙন পাওয়া গেছে। আমরা ১২০ মিটার পর্যন্ত এই ভাঙন রোধের চেষ্টা করছি। তবে এ বাঁধটি প্রকল্পের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে রক্ষার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে এর কাজ শুরু করা হবে।’

অপরদিকে, ডিমলা উপজেলার চরখড়িবাড়ি এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁধটি তিস্তার পানির তোড়ে ভেঙে গিয়ে এলাকার দুই হাজার পরিবার নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে।

গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র নদের তিস্তামুখ ঘাটে পানি বেড়ে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটারের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া তিস্তা, যমুনা, করতোয়া, ঘাঘট নদীর পানিও বেড়েছে। তিস্তা ও ঘাঘট নদীর শহর পয়েন্টে পানি বিপদসীমা ছুঁইছুঁই করছে। যেকোনো সময় কয়েকটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে জানিয়েছে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড।

বৃষ্টি আর উজানের ঢলে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর তীরবর্তী গাইবান্ধার চরসহ নিম্নাঞ্চলের অন্তত ২০টি গ্রাম ডুবে গেছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ। এসব এলাকার কাঁচা রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। পানিতে ডুবে গেছে ধানের বীজতলা, পাট, মরিচসহ বিভিন্ন ফসলের জমি। পানি বৃদ্ধি আর তীব্র স্রোতের কারণে নদীর তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে এরই মধ্যে চার উপজেলার অন্তত পাঁচ শতাধিক বসতভিটা ও আবাদি জমি নদীতে তলিয়ে গেছে।

পানি বেড়ে যাওয়ায় তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীতে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নদী তীরের অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবারের মানুষ ভিটেমাটি হারিয়েছেন। সবচেয়ে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে সুন্দরগঞ্জের হরিপুর, কাপাসিয়া, বেলকা, সদরের কামারজানি, গোঘাট, ফুলছড়ির ফজলুপুর, এরেন্ডাবাড়ি, উড়িয়া ও গজারিয়াতে। হুমকির মুখে রয়েছে শত শত বসতভিটা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, ফসলি জমিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। অনেকে তাদের সহায়-সম্পদ নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান জানান, গত কয়েক দিন ধরে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি অল্প অল্প বাড়লেও বৃহস্পতিবার থেকে পানি বৃদ্ধির হার বেড়ে গেছে। শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া তিস্তা ও ঘাঘটের শহর পয়েন্টে পানি বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। আরো দুই-এক দিন পানি বাড়তে পারে। নদীর তীরবর্তী ও চরাঞ্চলে বসবাসকারীদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

ঢল আসছে উত্তর-পূর্ব দিক থেকেও: দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদীগুলো দিয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি আসছে এবং বৃষ্টির কারণেও পানি বাড়ছে। সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি শনিবার বিপদসীমার ৮৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক ভুইয়া জানান, শনিবার সকাল পর্যন্ত জেলার ১১টি উপজেলার ১৫ হাজার পরিবারের ৮০ হাজার লোক পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। জেলার বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার, সুনামগঞ্জ সদর, জামালগঞ্জ, ধরমপাশা উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড গত ২৪ ঘণ্টায় ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে।

সরেজমিন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কুতুবপুর গ্রাম পরিদর্শন করে আমাদের প্রতিনিধি জানান, গ্রামের রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় মানুষের চলাচলে খুব অসুবিধা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিটি বাড়িতে পানি ঢোকায় গ্রামবাসী গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে বিপদে আছেন। পানির কারণে তারা রান্না করতে পারছেন না। এ কারণে গ্রামবাসীকে শুকনো খাবার খেতে হচ্ছে।

এদিকে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের মনু ও ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কমলগঞ্জ উপজেলার পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের রামপাশা এলাকায় ধলাই নদীর একটি স্থানে বাঁধ ভেঙে রামপাশা এলাকা প্লাবিত হয়েছে। শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত মনুর পানি বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ও ধলাইর পানি বিপদসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে পানি কমতে শুরু করেছে।

মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী শনিবার দুপুরে বলেন, ‘টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে মনু ও ধলাই নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। তবে পানি নামতে শুরু করেছে। বন্যা মোকাবিলায় আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।’