দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বাংলাদেশস্থ পাকিস্তানভিত্তিক হাবিব ব্যাংকের যোগসাজশে ৯ ব্যক্তি ও ১ প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা টাকা ১৫৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা করা ফাঁকি দিয়ে পাকিস্তানে নিয়ে গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্ত প্রতিবেদনে কর ফাঁকির চাঞ্চল্যকর এ তথ্য উঠে এসেছে।

রও পড়ুন…

ছয় ইস্যুতে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার আভাস 

অপরদিকে কর পরিশোধ ছাড়াই শেয়ার বিক্রির টাকা স্থানান্তরের বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মতামত চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মামুনুল হক এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে অনিবাসী বিনিয়োগকারীর কর বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। মতামত পাওয়ার পর হাবিব ব্যাংকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

রও পড়ুন…

ঢাকাস্থ করাচিভিত্তিক হাবিব ব্যাংকের অফিসে ফোন করলে জানা যায়, ব্যাংকের কান্ট্রি ম্যানেজার সেলিম বারকাত ভ্রমণে রয়েছেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। পরে ব্যাংকের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (সেন্ট্রাল অপারেশনস) মো. মনির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, সেকশন নিয়ে কনফিউশন রয়েছে। আমরাও বিষয়টি বুঝতে পারছি না। আমাদের আইনজীবী দেখছেন। হাবিব ব্যাংকের সহায়তায় টাকা পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।’

জানা যায়, পাকিস্তানের করাচিভিত্তিক হাবিব ব্যাংক লিমিটেড (এইচবিএল) একটি বহুজাতিক ব্যাংক। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে ব্যাংকটি আন্তর্জাতিক যাত্রা শুরু করে। ১৯৫১ সালে ব্যাংকটি প্রথম বিদেশি শাখা খোলে শ্রীলঙ্কায়। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে শাখা চালু করে। এক হাজার ৬০০ শাখা, এক হাজার ৭০০ এটিএম এবং বহির্বিশ্বের ২৯টি দেশে এ ব্যাংকের কার্যক্রম রয়েছে। বাংলাদেশে হাবিব ব্যাংকের একটি কান্ট্রি অফিস ও ছয়টি শাখা অফিস রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তথ্যের ভিত্তিতে হাবিব ব্যাংকের মাধ্যমে শেয়ার হস্তান্তরের টাকা কর পরিশোধ ছাড়াই স্থানান্তরের বিষয়টি খতিয়ে দেখে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পরিদর্শন রিপোর্ট দেওয়া হয়, যাতে বলা হয়, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ৯ ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে
অনিবাসী বিনিয়োগকারী’ হিসেবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন। তারা হাবিব ব্যাংকের অনিবাসী বিনিয়োগকারী হিসাবধারী (এনআইটিএ) হিসাবের বিপরীতে বৈদেশিক পেমেন্টের ক্ষেত্রে ১৫৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকার আয়কর ফাঁকি দিয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্যাংকের ১০টি এনআইটিএ হিসাবধারী গ্রাহক ক্যাপিটাল গেইন (মূলধন বৃদ্ধি) ও ডিভিডেন্ডের (লাভ) বিপরীতে এ আয়কর ফাঁকি দিয়েছে। ব্যাংকটি আয়কর আইন, ১৯৮৪-এর ৫৬(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে এসব গ্রাহককে কর পরিশোধ ছাড়াই টাকা স্থানান্তরে সহযোগিতা করেছে। এর মধ্যে ক্যাপিটাল গেইন ও ডিভিডেন্ডের ওপর কর ১১১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। সময়মতো কর পরিশোধ না করায় আইনের ৫৭(২) অনুযায়ী বিলম্ব ফি ৪৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। মোট কর ফাঁকি ১৫৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ক্যাপিটাল গেইনের (মূলধন বৃদ্ধি) ক্ষেত্রে আয়কর অধ্যাদেশের ৫৬(১) ধারা অনুযায়ী ১৫ শতাংশ উৎসে কর কার্যকর রয়েছে। অর্থ স্থানান্তরের আগে এই কর আদায় হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের। কিন্তু হাবিব ব্যাংক সেটি নিশ্চিত না করেই অর্থ স্থানান্তর করেছে। তাই ফাঁকি দেওয়া কর হাবিব ব্যাংককেই পরিশোধ করতে হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কর ফাঁকির ওই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হাবিব ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এনবিআরকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা স্থানান্তর গাইডলাইন অনুযায়ী কোনো ব্যাংক অনিবাসী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রির মূল্য এনআইটিএ হিসাবে ক্রেডিট করার আগে কোনো কর বকেয়া রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে হয়। কিন্তু হাবিব ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে জানায়, এসব অনিবাসী গ্রাহক স্টক এক্সচেঞ্জ নিবন্ধিত কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ারে বিনিয়োগ করে। শেয়ার বিক্রির সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১০ সালের ১ জুলাইয়ের একটি আদেশ (এসআরও-২৬৯/২০১০) অনুযায়ী ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স পরিশোধ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট স্টক এক্সচেঞ্জ বা ব্রোকারেজ হাউস কর কর্তনের প্রমাণসাপেক্ষে ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে।

এনবিআরের সেই আদেশ অনুযায়ী, যেসব শেয়ারহোল্ডারের স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি বা কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের অধিক পরিমাণ শেয়ার রয়েছে, তাদের এ কোম্পানি বা কোম্পানিগুলোর সিকিউরিটিজ লেনদেন থেকে অর্জিত আয়ের ওপর পাঁচ শতাংশ হারে আয়কর প্রযোজ্য হবে। এনআইটিএ ১০টি হিসাবের মধ্যে মাত্র একটি হিসাবের ১০ শতাংশের অধিক শেয়ার ছিল। ফলে হাবিব ব্যাংকের ব্যাংক সঠিক নয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

হাবিব ব্যাংক বলেছে, প্রযোজ্য কর কর্তনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হলো সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউস ও স্টক এক্সচেঞ্জ। অপরদিকে ব্যাংকের কাজ হলো ব্রোকারেজ হাউস থেকে প্রাপ্ত অর্থ এনআইটিএ হিসাবে প্রেরণের আগে কোনো কর বকেয়া রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী হাবিব ব্যাংক কর কর্তন নিশ্চিত হতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাংকটি আয়কর আইনের ৫৬(১) অনুযায়ী প্রমাণ গ্রহণ না করে এনআইটিএ গ্রাহকদের অর্থ স্থানান্তরে সহযোগিতা করেছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকটির অজ্ঞতা বা যোগসাজশ বা গাফিলতি ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ফাঁকি দেওয়া কর পরিশোধ করতে হাবিব ব্যাংককে নির্দেশ দিলেও তারা ওইসব অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আইনজীবীদের মতামত নিয়ে বলেছে, ওই করের অর্থ আদায়ের দায় তাদের নয়, সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউস বা স্টক এক্সচেঞ্জের। তারা শেয়ার বিক্রির টাকা থেকে করের টাকা আদায় করেনি। মতামত নিয়ে হাবিব ব্যাংক বলেছে, আয়কর আইনের অনুচ্ছেদ-৫২এম অনুযায়ী প্রদত্ত কর শেয়ার হস্তান্তরজনিত এবং এটি ক্যাপিটাল গেইন নয়। অনিবাসী বিনিয়োগকারীদের বিদ্যমান প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ ৫৬(১) অনুযায়ী ক্যাপিটাল গেইন কর কর্তন প্রযোজ্য হবে কি না, সে বিষয়ে এনবিআরের মতামত নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলেছে হাবিব ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠিতে কর ফাঁকির বিষয়ে আয়কর আইন অনুযায়ী মতামত দিতে এনবিআরকে বলেছে। যাতে বলা হয়, হাবিব ব্যাংকের এনআইটিএ ১০টি গ্রাহকের ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শেয়ার বিক্রির ক্যাপিটাল গেইনের জন্য আয়কর আইনের অনুচ্ছেদ-৫৬এম, নাকি ২০১০ সালের আদেশ, নাকি ৫৬(১), নাকি অন্য কোনো আদেশ অনুযায়ী ১৫ শতাংশ হবে, তার ওপর মতামত দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া ডিভিন্ডেন্ডের ওপর ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কর ৩০ শতাংশ কার্যকর ও আয়কর আইনের ৫৭(২) অনুযায়ী প্রতি মাসে দুই শতাংশ হারে জরিমানা হবে কি না, তাও জানাতে বলা হয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন নীতিমালা অনুযায়ী, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হলে যে কোনো ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের নিবন্ধন আছেÑএমন শাখায় বৈদেশিক মুদ্রা হিসাব খুলে সেখানে বৈদেশিক মুদ্রা জমা করতে হয়। এ হিসাবের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট শাখায় একটি নন-রেসিডেন্ট ইনভেস্টরস টাকা অ্যাকাউন্ট (নিটা) হিসাব খুলতে হয়। বৈদেশিক মুদ্রা হিসাব থেকে নিটা হিসাবে টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্রোকারেজ হাউসের হিসাবে টাকা স্থানান্তর করে শেয়ার কেনাবেচা করতে হয়।

আবার শেয়ার বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যায়, তা ব্রোকারেজ হাউস থেকে নিটা হিসাবে আনতে হয়। পরে সেগুলো বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে যায়। এরপর তা বিদেশে নেওয়া যাবে। নিয়ম অনুযায়ী অনিবাসী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রির টাকা নিটা হিসাবে স্থানান্তরের আগে গ্রাহক এর বিপরীতে যথাযথভাবে কর পরিশোধ করেছে কি না বা কোনো প্রকার কর বকেয়া রয়েছে কি না, তা ব্যাংককে নিশ্চিত হতে হবে। এরপর টাকা নিটা হিসাবে স্থানান্তর করা যাবে।